শরীর গঠন প্রতিযোগিতায় ঘুরেফিরে আসে চট্টগ্রামের এই জিমের নাম

জাতীয় শরীর গঠন প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্ব অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ৩১ ডিসেম্বর। এবারের প্রতিযোগিতায় দলগতভাবে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে আনসার আর রানার্সআপ চট্টগ্রামের মানস জিম। দেশে শরীর গঠন প্রতিযোগিতার নানা আয়োজনে ঘুরেফিরে আসে চট্টগ্রামের এই ব্যায়ামাগারের নাম। এখানে একসময় অনুশীলন করেছেন নারী বডিবিল্ডার মাকসুদা আক্তার।

স্কুলে পড়ার সময় রোগাপটকা ছিলেন মানস দেব। বন্ধুদের খুনসুটি সইতে না পেরে কত কি না করেছেন। সময়ে-অসময়ে ভাত খেয়েছেন, বাদ যায়নি ভাতের মাড় গেলাও। তারপরই কার যেন পরামর্শে ভর্তি হয়েছিলেন ব্যায়ামাগারে। ভর্তির পর ব্যায়ামের যন্ত্রপাতি কেনেন, রোজ সেসব নিয়েই পড়ে থাকতেন। এসব দেখে লোকজন বলতেন, ‘ট্যায়া দিইয়ারে লোয়া আলগার ইতি (টাকা দিয়ে এ লোহালক্কর তোলে)।’ কেউ কেউ বলতেন, ‘পাগল হয়ে গেছে নাকি!’

পরিবারের লোকজনও নানা কথা বলতেন। ছেলে পড়ালেখা করে ভালো কিছু হবেন, এটাই ছিল মা–বাবার স্বপ্ন। কিন্তু আস্তে আস্তে আরও বেশি করে শরীরগঠনে ঝুঁকে পড়েন মানস। নানাজনের নানা কানকথায় পিছু হটেননি। ব্যায়ামকে ধ্যানজ্ঞান করে নেন চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার কালিহাটের মানস।

শরীরগঠনে আগ্রহী তরুণদের সঙ্গে মানস দেব (মাঝে)
ছবি: সৌরভ দাশ

স্বপ্নপূরণ

০০২ সালে চট্টগ্রাম নগরের বহদ্দারহাটে একটি ব্যায়ামাগার চালু করেন মানস দেব। নিজের নামেই নাম রাখেন ‘মানস জিম’। নিজে ব্যায়াম করার পাশাপাশি অন্য ছেলেমেয়েদেরও ব্যায়াম করানো শুরু করেন। ওই বছরই মিস্টার বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় সপ্তম হন মানস। ২০০৭ সালে একই প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন। ২০০৯ ও ২০১১ সালেও হন দ্বিতীয়।

মানস বলেন, ‘টানা রানারআপ হওয়ার পর আমি কোচিংয়ে সময় দিই বেশি। ব্যায়ামবিদ তৈরিতে মনোযোগী হই।’ ২০১৩ সালে মিস্টার মাসল ম্যানিয়া প্রতিযোগিতায় কোচ হিসেবে তাঁর যাত্রা শুরু হয়। পরে মিস্টার বাংলাদেশসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় দলগতভাবে অংশ নিতে শুরু করে মানস জিম।

২০১৪ সালে ‘মিস্টার ঢাকা’ উন্মুক্ত শরীরগঠন চ্যাম্পিয়নশিপে সামগ্রিকভাবে চ্যাম্পিয়ন হয় মানস জিম। এ বছরও একই প্রতিযোগিতায় গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয় মানস জিম। বিভিন্ন শ্রেণিতে ২৭ জন অংশ নিয়ে পুরস্কার পান ১৭ জন। চারজন হন একক ইভেন্টে চ্যাম্পিয়ন।

মানস দেবের মিস্টার বাংলাদেশ হতে না পারার আক্ষেপ ঘুচিয়েছেন তাঁর শিষ্যরা
ছবি: সৌরভ দাশ

মিস্টার বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় ২০১৫ সালে প্রথম রানার্সআপ হয় চট্টগ্রামের এই জিম। এরপর ২০১৬ সাল ছাড়া প্রতিবারই রানার্সআপ হয়ে আসছে মানসের জিম। সর্বশেষ জাতীয় শরীরগঠন প্রতিযোগিতায় মাস্টার্স বিভাগে মানস জিমের এহসানুল তৃতীয় হন, ৮০ কেজি ওজন শ্রেণিতে চতুর্থ স্থান অর্জন করেন মেজবাহ।

ব্যায়ামবিদ তৈরির কারখানা

মানস দেবের মিস্টার বাংলাদেশ হতে না পারার আক্ষেপ ঘুচিয়েছেন তাঁর এক শিষ্য। ২০১৫ সালে মিস্টার বাংলাদেশ হয়েছেন তাঁর জিমের সাইফুল ইসলাম। এ ছাড়া ব্যায়ামে আন্তর্জাতিক সাফল্য পাওয়া মাকসুদা আক্তারও একসময় মানস জিমে অনুশীলন করেছেন।

চট্টগ্রামে শ খানেক জিম গড়ে উঠেছে এখন। এসব ব্যায়ামাগারের মালিকদের সংগঠন চট্টগ্রাম জিম ওনার্স সমিতির সম্পাদকও মানস দেব। এ ছাড়া বাংলাদেশ বডি বিল্ডিং ফেডারেশনের তিনি যুগ্ম সম্পাদক। ২০১৯ সালে তাঁর কাছে আসে জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। দেশের সেরা বডিবিল্ডিং কোচ হিসেবে মানসকে দেওয়া হয় গোল্ড মেডেল।

চট্টগ্রাম শহরে মানস জিমের বর্তমানে চারটি শাখা। বহদ্দারহাট, রাহাত্তারপুল, ওয়াসা ও গোলপাহাড়। পটিয়া ও চন্দনাইশে আরও দুটি জিম রয়েছে। মানস বলেন, ‘পটিয়া ও চন্দনাইশের জিম দুটি থেকে কোনো আয় আসে না। এলাকার ছেলেদের মাদক থেকে দূরে রাখতেই এগুলো চালাচ্ছি। ব্যায়াম মাদক থেকে মানুষকে দূরে রাখতে সাহায্য করে।’ মানস বলেন, ‘ইতিমধ্যে ৫০০ ব্যায়ামবিদ তৈরি করেছি। আরও অন্তত ১৫০ জন কঠোর অনুশীলন করে চলেছেন। শরীরগঠনের পাশাপাশি জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি চান যাঁরা, তাঁদের তৈরি করছি।’ আছে মেয়েদের অনুশীলনের সুযোগ।

মানসের বর্তমান লক্ষ্য জাতীয় পর্যায়ের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাফল্য অর্জন। সে লক্ষ্যেই ব্যায়ামবিদ তৈরি করে চলেছেন।