সুকান্তের বাড়িতে একবেলা

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের বাড়ি এখন গ্রন্থাগার ও মিলনায়তন। সড়কদ্বীপে সুকান্তের প্রতিকৃতি (ডানে)
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের বাড়ি এখন গ্রন্থাগার ও মিলনায়তন। সড়কদ্বীপে সুকান্তের প্রতিকৃতি (ডানে)

সেই চিরচেনা ছবি! গালে হাত দিয়ে বসে আছেন কবি। একবার নয়, দুই-দুবার কবির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল! প্রথমে কোটালীপাড়া শহরের তিন রাস্তার মোড়টা পেরোতেই। একটু পরে উনশিয়া গ্রামে কবির বাড়িতে। দুয়ারে দাঁড়িয়ে যেন আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য।
ঢাকা থেকে আমরা কজন সাংবাদিক কিছুদিন আগে গোপালগঞ্জে গিয়েছিলাম বাংলাদেশ প্রিমিয়ার ফুটবল লিগ (বিপিএফএল) কাভার করতে। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত জেলায় যে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের পৈতৃক ভিটা, তা আমাদের আগেই জানা ছিল। একদিন সিদ্ধান্ত নিলাম কবির পৈতৃক ভিটা দেখতে যাব। আমার আগ্রহটা একটু বেশিই। প্রথম আলোর এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর স্লোগানটা ‘এ দেশের বুকে ১৮ আসুক নেমে’ লাইনটাও যে কবির ‘আঠারো বছর বয়স’ কবিতা থেকেই নেওয়া। তা ছাড়া শৈশবে, কৈশোরে সুকান্তের কবিতা পড়ার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়েও পাঠ্য ছিল তাঁর বই। কবির স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটিতে তাই যাওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না কিছুতেই।
সকালের সূর্যটা তখনো ভালোভাবে তেতে ওঠেনি। আমাদের মাইক্রোবাস গোপালগঞ্জ শহর থেকে এগিয়ে চলেছে কোটালীপাড়ার উদ্দেশে। গাড়িতে যমুনা টেলিভিশনের সাংবাদিক নাভিল খান, ক্যামেরা পারসন জাকির হোসেন ও আমি। কবির বাড়ির ঠিকানা জানতে কোটালীপাড়া শহরের মোড়ের একজন দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করতেই দেখিয়ে দিলেন। একটু পর তিন রাস্তার মোড়ে দেখি গালে হাত দিয়ে বসা বিশাল আকৃতির সুকান্ত ভট্টাচার্যের ওই ভাস্কর্য।
মোড় থেকে ডান দিকে এগোলোই সরু পিচের রাস্তা। গ্রামের রাস্তা ধরে ১৫-২০ মিনিট এগোতেই দেখা মিলল কবির পৈতৃক ভিটা। ১৯২৬ সালের ১৫ আগস্ট কলকাতায় নানার বাড়িতে জন্মেছিলেন কবি সুকান্ত। কোটালীপাড়ার উনশিয়া গ্রামের এই বাড়িটি তাঁর বাবার ভিটা। এখানে কবির আত্মীয়স্বজন কেউই নেই। বাড়িটি পাবলিক লাইব্রেরি হিসেবে ব্যবহার করেন স্থানীয় ব্যক্তিরা। পাঁচ বছর আগে সংস্কার করে এটিকে বানানো হয়েছে কবি সুকান্ত পাবলিক লাইব্রেরি কাম অডিটরিয়াম। পুরোনো আমলের বাড়িটি মনে হলো নতুন করে রং করা হয়েছে।
কবির বাড়িতে ঢুকতেই দেখি মূল ফটকে তালা লাগানো। বাড়ির সামনেই বড় একটা পুকুর। শানবাঁধানো ঘাটও রয়েছে। বাড়ির কেয়ারটেকারের সন্ধান করেও খোঁজ মিলল না। অবশেষে দেয়াল টপকে ঢুকলাম কবির বাড়িতে। বারান্দার সামনে রয়েছে কবির একটি মূর্তি। এক পাশে রক্তজবা ফুলের গাছ। উঠানের সবুজ ঘাসে কয়েকটি ছাগলও চরতে দেখা গেল। ঘরগুলো তালা দেওয়া থাকায় ভেতরে ঢোকা সম্ভব হলো না। তবে জানালায় উঁকি দিয়ে দেখলাম কবির লেখা নানা বই শেলফে সাজানো। আছে কবির একটি জলরঙের পোট্রে৴ট। কয়েকটি সোফা। বারান্দায় পড়ে আছে ভাঙা একটি ড্রেসিং টেবিল।
বাড়ির দেয়ালজুড়ে লেখা কবির বিখ্যাত সব লাইন, ‘কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি,/ ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়:/ পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’; ‘মুখে-মৃদু-হাসি অহিংস যুদ্ধের/ ভূমিকা চাই না। ডাক ওঠে যুদ্ধের।’; ‘সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী/ অবাক তাকিয়ে রয়:/ জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার/ তবু মাথা নোয়াবার নয়।’ কবিতাগুলো যেন নতুন করে পড়ছি!
আমাদের তখন শহরে ফেরার তাড়া। অগত্যা পেছনে ফেলে আসতে হলো কবির স্মৃতিময় বাড়িটি। গুনগুনিয়ে আবৃত্তি করছি কবিতাটি, ‘আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ/ স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি,/ আঠারো বছর বয়সেই অহরহ/ বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।’