হেলেনের ট্রয় নগরে

ঢোকার মুখে কাঠের বিশাল ঘোড়া। সেই ট্রোজান! যার জন্য ধ্বংস হয়েছিল ট্রয় নগর। শানবাঁধানো চত্বরে খলনায়কের অপবাদ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঘোড়াটি। ঘোড়ার আদল হলেও এটি তিনতলা বাড়িই যেন। ফাঁপা পেটটিতে আছে দুটো তল। প্রতি তলার দুই পাশে অনেক ছোট জানালা। মই লাগানো ওপরে ওঠার জন্য। ওপরে উঠে ছোট জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই চোখে পড়ল ধ্বংসস্তূপের নগর—ট্রয়। প্রায় সোয়া তিন হাজার বছর আগে যে জনপদ ধ্বংস হয়েছিল, সেই সময়ে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী নারী স্পার্টার রানি ও ট্রয় রাজপুত্র প্যারিসের প্রেমিকা হেলেনের জন্য।
গ্রিস বা ইতালির রোমে নয়, ট্রয় নগরের অস্তিত্ব শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেছে তুরস্কের মানচিত্রে। এটি এখন সভ্যতা, প্রেম আর মানবতার প্রতীক হয়ে আছে। তুরস্কের চানাক্কেল প্রদেশের হিসারলিক এলাকায় কিংবদন্তির এই নগরের অবস্থান। ১৯৯৮ সালে ইউনেসকোর ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’ তালিকায় যুক্ত হয় ট্রয়। পর্যটক টানার জন্য তুর্কি শিল্পী ইজিট সেনিমুগলুর বানানো প্রতীকী ট্রোজান ঘোড়াটি এখানে বসানো হয়েছে সেই ১৯৭০ সালে।
গত ফেব্রুয়ারিতে চট্টগ্রামের একটি দলের সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলাম তুরস্কে। ইস্তাম্বুলের পর্যটন এলাকা তাকসিম চত্বর থেকে চানাক্কেল প্রদেশের ট্রয় নগর প্রায় ৩৫০ কিলোমিটারের পথ। পর্যটন সংস্থার মার্সিডিজ বেঞ্জ মাইক্রোবাসে ছয় ঘণ্টার পথে চোখধাঁধানো প্রকৃতির রূপ উপভোগের আনন্দ ছিল অন্য রকম। উঁচু–নিচু, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ আর দুই পাশে বিস্তীর্ণ মাঠ, পাহাড়। পাশে বহমান মারমারা সাগর আর শীতকাল বলে বাড়তি পাওনা রাস্তাঘাট, পাহাড় বরফ শুভ্র সৌন্দর্যে ঢাকা সবকিছু। একেবারে শেষে ফেরিতে ইজিয়ান ও কৃষ্ণ সাগরের সঙ্গে মারমারাকে যুক্ত করা দারদানালিস প্রণালি পাড়ি দিয়ে বন্দর শহর চানাক্কেল হয়ে পৌঁছালাম ট্রয় নগরে। তিন সাগরের সঙ্গমভূমি হিসেবেই নামটি হয়েছে ত্রাইয়া বা ট্রয়।
ট্রয় নগরে ঢোকার মুখেই ট্রোজান ঘোড়ার অবস্থান। তাই প্রথমেই ঢুকেছিলাম ঘোড়ার পেটে। ঘোড়া থেকে নেমে গাইড আহমেদের সঙ্গে পা বাড়ালাম নগরের মূল অংশে। সুনসান, নীরব পরিবেশ। চারদিকে শুধুই পাথুরে ধ্বংসস্তূপ—দেয়াল, প্রাসাদ, মন্দিরের ভগ্নাংশ। ছড়ানো-ছিটানো পানির পাত্র, ফুলদানিসহ নানা জিনিসের ধ্বংসাবশেষ। কোথাও ইটের ভাঙা দেয়াল। পাহাড়ের নিচে ছোট-বড় অসংখ্য টিলায় শহরটির অবস্থান হলেও আশপাশে বিশাল সমতল ভূমি। উঁচু একটা টিলা থেকে চোখে পড়ল দূরের ইজিয়ান সাগর, যে পথে গ্রিক বাহিনী শত শত জাহাজ নিয়ে এসেছিল হেলেনকে উদ্ধারে। তখন কাছে থাকলেও এখন সাগর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে ট্রয় নগর।
ইতিহাস বলছে, ১৮৭০ সাল থেকে খননের মাধ্যমে ধ্বংসপ্রাপ্ত ট্রয়কে খুঁজে বের করেন জার্মান ব্যবসায়ী ও প্রত্নতত্ত্ববিদ হাইনরিশ শ্লিমান। খননে এখানে নয়টি প্রাচীন শহরের অস্তিত্ব পাওয়া যায়, যেগুলো একটি আরেকটির নিচে ছিল। এর মধ্যে ট্রয়-৭-কে রাজা প্রিয়ম বা হেলেনের ট্রয় নগর বলে ধরা হয়। বেশির ভাগ প্রত্নতত্ত্ববিদ একমত, ট্রয়-৭-এর ধ্বংসের কারণ হেলেনকেন্দ্রিক ঐতিহাসিক ট্রোজান যুদ্ধ।

গাইড ইতিহাসের সঙ্গে খননকাজ ও প্রাপ্তির ফিরিস্তি দিয়ে চিনিয়ে দিচ্ছিলেন ট্রয়ের নিদর্শন, ধ্বংসস্তূপগুলো। নামফলক দিয়ে চিহ্নিত করা আছে খননে পাওয়া ট্রয়-১ থেকে ট্রয়-৯ পর্যন্ত বিভিন্ন স্তর, ছবিসহ বিস্তারিত বর্ণনা আছে নগর সুরক্ষা দেয়াল, এথেনার মন্দির, রাজা প্রিয়মের প্রাসাদের স্থান, এম্ফিথিয়েটার, আলটারসহ প্রতিটি নিদর্শনের।
ট্রয়-৭-এর একটি পাহাড়ি টিলা দেখিয়ে গাইড জানালেন, এখানেই ছিল হেলেনের প্রেমিক প্যারিসের পিতা ট্রয়ের রাজা প্রিয়মের প্রাসাদ, যিনি ট্রয়কে সমৃদ্ধ ও সম্পদশালী করেছিলেন। প্রাসাদের কোনো ভগ্নাংশও নেই, আশপাশে ছড়ানো ছিটানো শুধুই পাথর। প্রাসাদস্থান লাগোয়া উঁচু জায়গাটিতে বসেই হেলেনকে নিয়ে ট্রয় যুদ্ধ দেখা ও তদারক করেছিলেন প্রিয়ম, জানালেন গাইড। এর পাশের টিলা থেকেই রাজার গুপ্তধন (সোনা, মণি, মুক্তা, অলংকার) উদ্ধার করেছিলেন নাকি ট্রয় নগর আবিষ্কারক হাইনরিশ শ্লিমান। অ্যাপোলোর স্বর্ণমূর্তি, ভাঙা সিংহাসন, প্রাসাদের তোরণ, অস্ত্র, হস্তশিল্প, তৈজসসহ খুঁজে পাওয়া অনেক নিদর্শনের সঙ্গে গুপ্তধনও শ্লিমান নিয়ে গিয়ে সংরক্ষণ করেছিলেন জার্মানিতে নিজ বাড়িতে। এ জন্য তুর্কিদের কাছে তাঁর পরিচিতি আবিষ্কারক নয় ‘লোভী ব্যবসায়ী’। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মানি দখলের সময় ট্রয়ের সব সম্পদ নিয়ে গিয়ে পুশকিন জাদুঘরকে সমৃদ্ধ করে রাশিয়া।
এরপরই দেখলাম প্যারিসের তিরের আঘাতে গ্রিক বীর একলিশের নিহত হওয়ার চত্বরটি। তার পরেই পেলাম ট্রয়ের উল্লেখযোগ্য স্থাপনা আলটার বা বলির বেদি। বাইরের কোনার অংশবিশেষ ছাড়া মার্বেল পাথরের তৈরি বেদিটির বেশির ভাগ অংশই ধ্বংস হয়ে গেছে। সবশেষে দেখলাম নগরবাসীর বিনোদনকেন্দ্র এম্ফিথিয়েটার বা রঙ্গমঞ্চ, রোমের কলিসিয়ামের আদলে তৈরি করা।
মৌসুম নয় বলে পর্যটকের ভিড় তেমন ছিল না। একটি জাপানি দল ছাড়া হাতে গোনা কয়েকজনকে দেখা গেল। তাই ঘণ্টা দুয়েক মন ভরে দেখলাম, জানলাম ট্রয়কে। সূর্য ডোবার আগেই বেরিয়ে এলাম।
ফেরার পথে চানাক্কেল ফেরিঘাটের কাছে চোখে পড়ল ২০০৪ সালে মুক্তি পাওয়া হলিউডের সাড়া জাগানো ট্রয় চলচ্চিত্রে ব্যবহার করা কাঠের ঘোড়াটি, তুরস্ক সরকারকে শুভেচ্ছা স্মারক হিসেবে দিয়েছিলেন ছবির প্রযোজক।