'আমি কারও সঙ্গে মিশতে পারি না, নারী-পুরুষ কারও চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারি না'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম। তিনি আপনার মানসিক বিভিন্ন সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন।—বি. স.
মেহতাব খানম
মেহতাব খানম

সমস্যা
আমি স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। আমার প্রথম সমস্যা হলো আমি কারও সঙ্গে মিশতে পারি না, নারী-পুরুষ কারও চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারি না। ছোটবেলা থেকে আমি এ রকম, এমনকি সহপাঠীদের সঙ্গে কখনো মন খুলে কথা বলতে পারি না। কোনো বিষয় সহজে মানতে পারি না। আমার শৈশব থেকে এখন পর্যন্ত শুধু একজন বান্ধবী আছে, যার কাছে আমি সব কথা বলি। কিন্তু কিছু কথা তাকেও বলতে পারি না। আমি প্রায় সব বিষয় নিয়েই ভয় পাই। মাঝেমধ্যে খুব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে খুব বেশি দুশ্চিন্তা করি। ওই বান্ধবী ও আমার পরিবার ছাড়া অন্য কারও সামনে বসে কথা বলতে পারি না, খেতে পারি না।
আমার এক ভালো বন্ধু আছে, সে আমাকে অনেক ভালোবাসে। আমি তার সঙ্গে বসে কথা বলতে পারি না। সে আমাকে যথাসাধ্য চেষ্টা করছে এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য। নিজেকে ছোট মনে হয়, কোথাও একা যেতে পারি না। আমার কোনো কিছুই পছন্দ হয় না। খুব কষ্ট পেলেও কাউকে না বলে একা একা সহ্য করি। আমি চাই, যে আমার জীবনসঙ্গী হবে, তার সঙ্গে সব বিষয় ভাগ করব। মনে হয় এখন কোনো বন্ধুর সঙ্গে ভাগ করলে পরে যখন এসব স্মৃতি মনে পড়বে, তখন আরও বেশি কষ্ট হবে। মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমাকে দিয়ে কিছু হবে না। আমার বন্ধুটা আমার সবকিছু জানতে চায়, কিন্তু বলি না। অনেক সময় বলতে চেষ্টা করি, পারি না। এ জন্য পরে খারাপও লাগে, একা একা নীরবে কাঁদি।
আমার দ্বিতীয় সমস্যা হলো যৌন বিষয়ে ভয়, যা সাধারণত কাউকে বলতে পারি না। এক বছর আগে আমাকে সেই বন্ধু বিয়ের প্রস্তাব দেয়। আমার পরিবার রাজি হলে বিয়েটা হবে। তার পর থেকে বিয়ে নিয়েও ভয় হয়। যৌন বিষয়–আশয়গুলো আমার কাছে নোংরা কাজ মনে হয়। এটা নিয়ে বিভিন্ন আজেবাজে চিন্তা হয়। বিয়ে করতে ইচ্ছা করে না। বিষয়টা যখন মনে হয়, তখন লজ্জা ও অনেক ভয় হয়।
আমার বন্ধু আমাকে মানসিকভাবে অনেক সাহায্য করে। কিন্তু আমি মনের কথা বলতে পারি না, তার পরও সে আমাকে অনুপ্রাণিত করার জন্য নিজে কষ্ট সহ্য করে। সে খুব ভালো ছেলে। তার মতো মানুষকে যেকোনো মেয়ে দ্বিতীয়বার না ভেবে ভালোবাসবে। কিন্তু আমি বিভিন্ন দুশ্চিন্তার কারণে পারি না। ছোট থেকে এমন এক পরিবেশে বড় হয়েছি, যেখানে শুধু হতাশার কথা শুনেছি। আমার মা আমাকে সব সময় অন্য মেয়েদের সঙ্গে তুলনা করেন। তাই মাঝেমধ্যে প্রচণ্ড রেগে যাই। আমি চাই পড়াশোনা শেষে ভালো চাকরি করব। ইচ্ছা আছে মাস্টার্স করব, কিন্তু মা চাইছেন পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরিও করি। আমার বন্ধুও আমাকে পড়াশোনা শেষ করতে বলে। ইদানীং আবার তার সঙ্গে কথা না বললে ভালো লাগে না। আমাকে এমন কিছু পরামর্শ দিন, যাতে আমি অনেক উপকৃত হই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম
পরামর্শ
জীবনে চলার পথে অনেক দক্ষতার প্রয়োজন হয়। তার মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি দক্ষতা হচ্ছে মানুষের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদানের দক্ষতা। এটি শৈশব থেকেই তৈরি হতে থাকে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিজেকে প্রকাশ করার মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে বড়দের দায়িত্ব হচ্ছে শিশুদের আবেগ, চাহিদা, মনোভাব, চিন্তাধারাগুলো বুঝে তাকে সুন্দরভাবে নিজেকে প্রকাশ করার সুযোগ দেওয়া। শুধু তা–ই নয়, তার ঔত্সুক্য, আগ্রহগুলো খেয়াল করে ধৈর্য ধরে ওর প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়া এবং তাকে গুরুত্ব দেওয়া। এ ছাড়া সব সময় ছোট ছোট অর্জনের জন্য উত্সাহ দেওয়া ও প্রশংসা করা। তুমি যে বাইরের কারও চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারছ না বা কারও সামনে বসে খেতে পারছ না, সেটির জন্য সম্পূর্ণ দায়িত্ব তোমার নয়। কারণ, আমাদের দেশের পারিবারিক চর্চায় প্রথমত এই দক্ষতাগুলোর বিষয়ে না জানার কারণে সেগুলো শেখানো হয় না এবং দ্বিতীয়ত মেয়েদের বাইরের পৃথিবীতে পরিচিত হওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট বাধা দেওয়া হয়। তবে তুমি যেহেতু এখন এ ব্যাপারে সচেতন হয়েছ, আশা করা যায়, উদ্যোগ নিয়ে এই দক্ষতা অর্জন করতে পারবে।
এখন থেকে যতই লজ্জা লাগুক, তুমি চেষ্টা করবে অন্তত প্রথমে মানুষের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে এবং গুছিয়ে কথাগুলো না বলতে পারলেও নিজেকে এর জন্য মোটেও ছোট মনে করবে না। তোমার মা হয়তো বুঝতে পারেননি যে অন্যদের সঙ্গে সব সময় তুলনা করলে সন্তানদের আত্মবিশ্বাস একেবারে হারিয়ে যায়, তাই তিনি ভুল করেছেন। তুমি তো এখন প্রাপ্তবয়স্ক, নিজেকে কখনো কারও সঙ্গে একবারের জন্যও তুলনা কোরো না। প্রথম দিকে অপরিচিত কারও সঙ্গে সরাসরি চোখে চোখ রেখে কথা বলতে অসুবিধা হলেও চর্চা করতে করতে নিজেকে দক্ষ করে তোলা সম্ভব।
যৌন বিষয়ে তোমার ভীতির কারণ হচ্ছে, এটি জীবনের একটি বাস্তবতা হলেও এটিকে সুস্থ ও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে মানুষের কাছে উপস্থাপন করা হয় না। বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে উপযুক্ত বয়সে শেখানোর জন্য কিছু বিষয় সংযোজিত হলেও শিক্ষকদের এটি পড়ানোর জন্য প্রশিক্ষিত করা হয়নি। একই সঙ্গে অভিভাবকদের মধ্যেও সচেতনতা গড়ে তোলা হয়নি। ফলে বিষয়টি নিয়ে কানাঘুষা ও হাসাহাসি করা হয় বলে সমাজের একটি বড় অংশের কাছে এটি একটি নোংরা ও অবাঞ্ছিত বিষয় হিসেবেই রয়ে গেছে। তুমি এখন মাত্র দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছ। এখনই তো বিয়ের কথা ভাবার প্রয়োজন নেই। বিয়ের আগে অবশ্যই মাস্টার্স শেষ করবে, সেটি মাথায় রেখো। পড়াশোনার পাশাপাশি তুমি খণ্ডকালীন কোনো চাকরি করতে পারলে সামাজিক দক্ষতা বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। ছোটবেলা থেকে হতাশার যে কথাগুলো শুনেছ, তা একটি নোটবুকে লিপিবদ্ধ করে, তার পাশে প্রাপ্তবয়স্ক ‘তুমি’ উত্সাহব্যঞ্জক কী বলতে পারো, তা লিখে প্রতিদিন নিজেকে সেগুলো বলবে, কেমন?