'গিন্নি' কোনো কাজ করেন না!

সকালের নাশতা বানানো থেকে শুরু করে হালকা আর ভারী সব কাজই করতে হয় অনেক গৃহিণীকে। ছবি: অধুনা
সকালের নাশতা বানানো থেকে শুরু করে হালকা আর ভারী সব কাজই করতে হয় অনেক গৃহিণীকে। ছবি: অধুনা

একজন গৃহিণীকে যদি প্রশ্ন করা হয়, আপনি কী করেন? বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যে উত্তরটি পাওয়া যাবে তা হলো, ‘কিছু করি না, আমি একজন গৃহিণী।’ অথচ সবার আগে ঘুম থেকে উঠে সংসারের যাবতীয় খুঁটিনাটি কাজ শেষ করে সবার শেষে ঘুমাতে যাওয়া মানুষটি কিন্তু একজন নারী, একজন গৃহিণীই। কিন্তু আমাদের পরিবারগুলোতে, আমাদের সমাজে বা রাষ্ট্রে এই ‘গৃহিণী’ নারীর অবস্থান কোথায়?

আমি কোনো কাজ করি না 
৪৫ বছর বয়সী নীলুফার ইয়াসমিন (ছদ্মনাম) সংসার করছেন ২৪ বছর ধরে। ভোর পাঁচটায় কাজ শুরু করেন তিনি, শেষ হয় রাত ১২টায়। কখনো কখনো আরও সময় পর। নীলুফার বলেন, ‘স্বামী, সন্তানদের ভালোবেসে সংসারের কাজ করি। লেখাপড়া শিখেও বাইরের কাজ করি না বলে কোনো আক্ষেপ নেই। তবে মাঝে মাঝে খারাপ লাগে। বিশেষত যখন কোনো কারণে স্বামী বা সন্তানরা বলেন, “সারাদিন ঘরে থাকো, তোমার আর কাজ কী?” আমিও ভাবি, আমার আর কাজ কী! অথচ সারা দিন একটু বিশ্রামের সময় নেই।’
কলেজ শিক্ষক তাহমিনা হক (ছদ্মনাম ) বলেন, ‘শিক্ষকের পাশাপাশি আমি একজন গৃহিণীও, এটাই আমার প্রথম পরিচয়। যতই বাইরে কাজ করি না কেন, ঘরের কাজগুলো আমাকে করতেই হবে। আমার কাছে সংসারের কাজকে বরং অনেক কঠিন মনে হয়, সবার চাহিদা, পছন্দ মনে রাখতে হয়। একটু এদিক-ওদিক হলেই সংসারে শান্তি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে।’

গৃহিণী হওয়া খুব সহজ কিছু নয়। সন্তান লালনপালন থেকে শুরু করে সুন্দর করে সংসারকে গুছিয়ে রাখার গুরুদায়িত্ব কিন্তু বর্তায় তাঁদের ওপরই। তাহলে কেন ঘরের কাজকে ‘কাজ’ বলতে এত অনীহা? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারপারসন ও সহযোগী অধ্যাপক তানিয়া হক বলেন, ‘ঘরের কাজকে “কাজ” হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার মতো সামাজিক অবস্থাই এখনো তৈরি হয়নি। অর্থনীতিতে কাজের সঙ্গে সময়, শ্রম ও বেতনকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। গৃহিণীদের কাজে সময় যাচ্ছে, শ্রম যাচ্ছে শুধু একটি জিনিসের অভাবে, তাঁদের কাজটা “কাজ” হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে না। তাহলে যা করতে হবে, সবার আগে কাজের সংজ্ঞাই পরিবর্তন করতে হবে। অথবা রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে ঘরের কাজের জন্য পারিশ্রমিক দেওয়ার বিধান চালুর উদ্যোগ নিতে হবে। এটা খুব সহজ নয়। কিন্তু একবার উদ্যোগ নিলে একসময় তা সহজ হয়ে যাবে। কারণ অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া গৃহিণীর সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি সম্ভব নয়। তবে সবার আগে গৃহিণীদেরও স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে সংসারে তাঁদের অবস্থান খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং তাঁদের কাজ সবচেয়ে কঠিন ও শ্রমসাপেক্ষ।’

গৃহিণীদের কাজের পারিশ্রমিক

শুধু বাংলাদেশ নয়, উন্নত বিশ্বেও গৃহিণীদের সামাজিক মর্যাদা খুবই শোচনীয়। কাজের ক্ষেত্রে তাঁদের পারিশ্রমিক দেওয়ার বিষয়টি সমাজে স্বীকৃত নয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিষয়টা আরও কঠিন। খোদ গৃহিণীদের মধ্যেই অনেকের আপত্তি আছে পারিশ্রমিকের প্রশ্নে। তবে কেউ কেউ আছেন, যাঁরা তাঁদের প্রাপ্য অধিকারটুকু চান। নিজের গবেষণার বরাত দিয়ে এমনটিই জানালেন উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের তানিয়া হক।

সংসারের কাজের ক্ষেত্রে পারিশ্রমিক থাকা উচিত কি না, জানতে চাইলে গৃহিণী নীলুফার ইয়াসমিন বলেন, ‘নিজের সংসার, নিজের কাজ, এতে আবার পারিশ্রমিক লাগবে কেন? তবে স্বীকৃতি পেতে কার না ভালো লাগে। এ নিয়ে যদি সরকারি কোনো উদ্যোগ থাকে, তাহলে ভালোই হয়।’

তাহমিনা হক মনে করেন, সংসারের কাজের জন্য স্বামীর কাছ থেকে নগদ অর্থ নেওয়ার বিষয়টি মানসিকভাবে মেনে নেওয়াটা অনেকের জন্যই একটু কঠিন, তবে গৃহিণীদের অবশ্যই বিষয়টিকে অর্থনৈতিক মুক্তির দিক থেকে ভাবা উচিত। 

আমাদের সমাজে গৃহিণীরা সংসারের কাজকে নিজের দায়িত্ব মনে করেন বলেই স্বামীর কাছ থেকে অর্থ নেওয়ার বিষয়টি ভাবতেও পারেন না। তাঁরা পারিবারিক ও সামাজিক সম্মান চান। কিন্তু এই সম্মানের বিষয়টি নিশ্চিত হতে হলে পারিশ্রমিকের বিষয়টি সামনে চলে আসে। পারিশ্রমিক মানেই অর্থের বিনিময়ে কাজ নয়, পারিশ্রমিক হচ্ছে  সামাজিক স্বীকৃতি দানের প্রথম পদক্ষেপ।

ভালোবাসার সংসারে দেয়াল!

প্রায়ই আমরা অনেক গৃহিণীর আত্মহত্যার খবর পাই। গৃহিণীকে, স্ত্রীকে নির্যাতন-নিপীড়নের অনেক উদ্বেগজনক ঘটনার কথা জানতে পারি পত্রিকার পাতায়। আত্মহননের মতো পথ বেছে নিতে বাধ্য হওয়া বা নির্যাতিত হয়ে সংসার ত্যাগ করতে বাধ্য হওয়া সেই গৃহিণীরাও নিশ্চয়ই সংসারযাত্রা শুরুর কালে অনেক ভালোবাসার স্বপ্ন, সুন্দরের স্বপ্ন নিয়েই স্বামীর ঘরে এসেছিলেন। কিন্তু নিজের প্রাপ্য মর্যাদা না পেয়ে, নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়নি দেখে তাঁদের এই পরিণতি হয়। এ ধরনের প্রেক্ষাপটে গৃহিণীর অর্থনৈতিক মুক্তিই নিজের ঘরে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অনেকখানি ভূমিকা রাখতে পারে। 

বিশ্বজুড়ে শতভাগ গৃহকর্মের জন্য যে গৃহবধূ নিয়োজিত থাকেন, তাঁকে তাঁর  শ্রম-মূল্য দেওয়ার আওয়াজ উঠছে। এই মূল্য দিলে ভালোবাসার সংসারে দেয়াল তৈরি হবে, এমনটা ভাবার কারণ নেই। কাউকে কারও প্রাপ্য মর্যাদা না দিলে, তাঁর অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাধা দিলেই বরং সংসারে, সমাজে ‘দেয়াল’ ওঠে। তাই সংসারে, সমাজে এই দেয়াল উঠতে না দিয়ে, নারীর প্রাপ্য প্রতিষ্ঠায় প্রত্যেক সচেতন পুরুষকেই এগিয়ে আসতে হবে। কেননা ‘পুরুষপ্রধান’ সমাজকে ‘মানবপ্রধান’ করার কাজ পুরুষদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছাড়া সম্ভব নয়।

গৃহিণীর শ্রম-ঘাম-মেধাই পরিবারের শক্তি

এটা অনুধাবন করতে হবে যে, ‘গৃহিণী’ চরিত্রটি দূরের কেউ নন, আমাদের মা, স্ত্রী, বোন, কিংবা মেয়ে। এঁদের প্রত্যেকেই জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে গৃহিণী বনে যাচ্ছেন, সমাজই তাঁদের ‘গৃহিণী’ বানিয়ে দিচ্ছে। একবার ভাবুন, একজন ‘গৃহিণী’র কোনো ছুটি নেই, বছরের প্রতিটি দিন তাঁকে সংসারের যাবতীয় কাজ করতে হয়। কোনো কারণে যদি একদিন তিনি সব কাজ বন্ধ রাখেন, তাহলে কত ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় পরিবারের সব সদস্যকে। অক্লান্ত পরিশ্রম করে, অসীম ধৈর্য নিয়ে, মেধা মনন দিয়ে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সামাজিক সংগঠন পরিবারকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এই গৃহিণী নারীরাই।

৮ মার্চ ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’-কে ঘিরে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় মুখর আমরা যেন ‘গৃহিণী’র শ্রম-ঘাম-মেধার কথা ভুলে না যাই। সমাজে গৃহিণী নারীর যথাযোগ্য মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হোক। এই নারী দিবসে দুনিয়ার সব গৃহিণী নারীকে শ্রদ্ধা। শ্রদ্ধা ওই পুরুষদেরও, যাঁরা স্বামী হয়ে, পিতা হয়ে, ভাই হয়ে, ছেলে হয়ে নিজ নিজ সংসারে ‘গৃহিণী’র মর্যাদা দিতে চেয়েছেন, দিতে চান।

নারীর অধিকার, নারীর মর্যাদা, নারীর স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করতে হলে আমাদের কাজী নজরুল ইসলামের সেই অমর কবিতা বুঝতে হবে—‘বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’