থেরাপিস্ট হয়ে মারজানা বললেন, ‘এক সময় থেরাপি নিয়েছি, এখন থেরাপি দেব’

দুর্ঘটনায় মেরুদণ্ডে আঘাত পেয়ে পড়াশোনা করার স্বপ্নই হারাতে বসেছিলেন। সাভারের সিআরপিতে ফিজিওথেরাপি নিতে গিয়ে জানলেন, সেখানে পড়াশোনাও করা যায়। ইন্টার্নসহ স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি বিষয়ে এবার সেখান থেকেই স্নাতক হলেন মারজানা আক্তার। পড়াশোনার পাশাপাশি অধিনায়ক হিসেবেও নেতৃত্ব দিয়েছেন সিআরপির নারী হুইলচেয়ার বাস্কেটবল দলের। তাঁর জীবনের আরও গল্প শুনে অনুলিখন করেছেন সজীব মিয়া

এলবো ক্রাচে ভর করেই চলতে হয় মারজানা আক্তারকে
ছবি: মারজানা আক্তারের সৌজন্যে

সময়ের আগেই অফিসে হাজির হওয়ার চেষ্টা করি; কিন্তু সেদিন গেলাম একদম কাঁটায় কাঁটায়। মিরপুর সিআরপিতে ততক্ষণে রোগীদের আনাগোনা বেড়ে গেছে। দ্রুত গিয়ে চেম্বারে বসি। আমি বসতে না বসতেই একজন রোগীও ঢোকেন। আমাকে দেখেই তাঁর চোখ ছানাবড়া হওয়ার জোগাড়। আমি অবশ্য অবাক হলাম না; কারণ আমার জন্য এমন অভিজ্ঞতা প্রথম নয়। 

মনে পড়ল, একই লিফটে আমরা ওপরে এসেছি। তিনি আমার হাতে ক্রাচ দেখে তখন হয়তো ভেবেছিলেন, থেরাপি নিতে এসেছি। এখন যখন আমার চেম্বারে এলেন এবং থেরাপিস্ট হিসেবে আমাকেই দেখলেন, তখন ঠিক আস্থায় নিতে পারলেন না। একজন ক্রাচে ভর করে হাঁটা মানুষ কীভাবে তাঁর সেবা করবেন! পরে তাঁকে বোঝাই, আস্থায় এনে তাঁর চিকিৎসা শুরু করি। 

আবার এর উল্টো ঘটনাও আছে। কম বয়সীদের নিয়ে যখন মা-বাবারা আসেন, প্রতিবন্ধকতা নিয়ে আমাকে কাজ করতে দেখে তাঁরা সাহস পান, অনুপ্রেরণা খুঁজে নেন। সন্তানকে বলেন, ‘দেখলে তো, তুমিও সুস্থ হয়ে যাবে।’

আমার পথচলার সঙ্গী এখন একটি এলবো ক্রাচ। এতে ভর করেই আমাকে হাঁটতে হয়। অথচ এক সময় হুইলচেয়ারেও বসতে হয়েছিল। তারপর ফিজিওথেরাপি নিতে নিতে এলবো ক্রাচে দুহাতে ভর করে দাঁড়ালাম। মনোবল বাড়ল। পড়াশোনার বিরতি কাটিয়ে সাহস করে ভর্তি হলাম কলেজে। এইচএসসি পাস করতে করতেই শুনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের অধীন সিআরপিতেই (পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র) বিএসসি ইন স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি বিষয়ে পড়ার সুযোগ আছে। যে প্রতিষ্ঠান আমাকে নতুন জীবনের সন্ধান দিল, সেখানে পড়তে পারা তো ভাগ্যের ব্যাপার। ২০১৯ সালে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে সেই সুযোগও পেলাম। রোগী থেকে হয়ে গেলাম শিক্ষার্থী। 

স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি বিষয়ে চার বছরের কোর্সের সঙ্গে এক বছরের ইন্টার্নশিপ। এ মাসেই আমার ইন্টার্নশিপও শেষ হলো। মিরপুরের সিআরপিতে এই এক বছরে কত অভিজ্ঞতাই না হলো। জীবনকে বোঝার সেই অভিজ্ঞতার শুরু এক দশক আগে, যখন এক দুর্ঘটনা আমার জীবনকে ওলট-পালট করে দিয়েছিল।

মারজানা আক্তারকে হুইলচেয়ারেও বসতে হয়েছিল
ছবি: প্রথম আলো

গাছ থেকে পড়ে গেলাম

২০১৫ সালের ৬ জুন। পরদিন উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তির জন্য ঢাকায় আসব। বাড়িতে তারই প্রস্তুতি চলছিল। সকালে ছোট বোনকে তৈরি করে স্কুলে পাঠিয়েছি। দুপুর তখন সাড়ে ১২টা। আমাদের কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরের বাড়ির সামনে ছোট জামগাছ ছিল। দুই দিন ধরে বিদ্যুৎ নেই বলে গরমে একটু বাতাসের জন্য গাছে উঠেছিলাম। ছোটবেলায় ডানপিটে স্বভাবের ছিলাম। গাছে চড়া আমার কাছে নেশার মতো। সেদিনও গাছে বসে ছোট বোনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আমাকে গাছে দেখে আপু আর আম্মা তাগাদা দিচ্ছিলেন নামার জন্য; কিন্তু আমি কেন শুনব তাঁদের কথা! 

বিরক্ত হয়ে আম্মা একসময় চলে গেলেন। আপুও একটু দূরে যাওয়ার পর জামগাছের ডাল ভেঙে মাটিতে পড়ে গেলাম। মাটিতে পড়ে মনে হয়েছিল, আমি একটি ডাবলিং বল। একবার ওপরে উঠছি, আবার নিচে পড়ছি। এর পরের পাঁচ মিনিট কিছুই মনে নেই। 

যখন জ্ঞান ফিরল, তখন দেখি আমি আমার ঘরে। চারপাশে মানুষ। অনেকে মিলে ধরাধরি করে অটোরিকশায় করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হলো। ওখানকার দায়িত্বরত কর্মকর্তারা জানান, পিঠের পেশি ছিঁড়েছে। দ্রুত ঢাকায় নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হলো। ঢাকার আগারগাঁওয়ের নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতাল হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলো। দুই দিন পর চিকিৎসক জানান, স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি; মানে মেরুরজ্জুতে আঘাত পেয়েছি। মেরুদণ্ডে অস্ত্রোপচার করতে হবে। দুর্ঘটনার ১২ দিন পর ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচার হলো। 

সেই দুঃসহ সময়গুলো মনে পড়লে এখনো শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে। অস্ত্রোপচারের পর ফিজিওথেরাপির জন্য সাভারের সিআরপিতে ভর্তি হলাম। ভর্তি হওয়ার ১০ দিন পর এক্স-রে রিপোর্ট দেখে জানানো হলো—আমার প্রথম অস্ত্রোপচারে ভুল ছিল। আগের হাসপাতালেই দ্বিতীয়বার অস্ত্রোপচারের জন্য নেওয়া হলো। তারপর আবার সিআরপিতে গেলাম থেরাপির জন্য।

থেরাপি নেওয়ার সময় জানতে পারি, আমি আর আগের মতো চলাফেরা করতে পারব না। খুব ভেঙে পড়লাম। পড়াশোনা নিয়ে কত স্বপ্ন আমার, সব কি হারিয়ে যাবে? খুব কাঁদলাম। তখন আমার মা-বাবাসহ সিআরপির চিকিৎসকেরা সাহস দিলেন। এতে কাজও হলো। আমি কয়েক মাসের মধ্যেই হুইলচেয়ার ছেড়ে দুটি এলবো ক্রাচ নিয়ে চলাচল করার শক্তি পেলাম। থেরাপি নেওয়ার সময়টা আমার কাছে পুনর্জন্মের মতো মনে হতে থাকল।

আরও পড়ুন
ক্লিনিক্যাল স্পিচ অ্যান্ড থেরাপিস্ট হিসেবে এখন পেশাজীবন শুরু করবেন মারজানা
ছবি: মারজানা আক্তারের সৌজন্যে

কোনো বাধাই আর বাধা নয়

থেরাপি নিয়ে বাড়ি ফিরে মনে হচ্ছিল কবে আবার পড়াশোনা শুরু করব। এর মধ্যেই ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে সিআরপি থেকে বাস্কেটবল দলে খেলার জন্য ডাক পড়ে। থেরাপি নেওয়ার সময় এক ঘণ্টা করে খেলার সময় পেতাম। আমি তখন হুইলচেয়ারে বাস্কেটবল খেলতাম। নারী হুইলচেয়ার বাস্কেটবল দল গঠন করা হলে সেই দলের হয়েই এক মাসের ক্যাম্পে অংশগ্রহণ করলাম। 

দলে আমি কনিষ্ঠ সদস্য। এক নতুন জীবনের শুরু হলো। এরপর বাস্কেটবল দলের হয়ে নেপাল, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডে যাওয়ার সুযোগ পেলাম। দলের অধিনায়কও বানানো হলো আমাকে। বিদেশে ঘুরে মনটাই বড় হয়ে গেল আমার। সেই নতুন জীবনে পড়াশোনাও শুরু করি ঢাকায় শেরেবাংলা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে। কলেজে যাওয়া, ক্লাস করা, চাট্টিখানি কথা ছিল না। বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মধ্যেই আমার কলেজজীবন শেষ হয় ২০১৯ সালে। এরপর তো আবার সিআরপির জীবন। 

এখন আরও আত্মবিশ্বাসী

ইন্টার্নশিপ শেষ! ক্লিনিক্যাল স্পিচ অ্যান্ড থেরাপিস্ট হিসেবে এখন আমি পেশাজীবন শুরু করব। এক দশক আগের চেয়ে এখন আমি আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী। মানসিক শক্তি আগের চেয়ে আরও বেড়ে গেছে। মনে হয়, কোনো বাধাই আর আমাকে দমিয়ে রাখতে পারবে না। এক সময় থেরাপি নিয়েছি, এখন থেরাপি দেব।

আরও পড়ুন