দেশ–বিদেশে খেলার চাপ সামলে যেভাবে জিপিএ–৫ পেলেন দিয়া

দিয়া সিদ্দিকী
ছবি: শামসুল হক

অঙ্কে ১০০ পাওয়া, নাকি নির্ভুল নিশানায় তির ছোড়া, কোনটা বেশি কঠিন? দিয়া সিদ্দিকীর কাছে যেন দুটোই সহজ।

খেলার মাঠে নিয়মিতই পদক আনছেন তিনি। এবার পড়াশোনায়ও দুর্দান্ত দেশসেরা এই আর্চার। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় দারুণ ফল করেছেন তিনি। বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অর্থাৎ বিকেএসপির শিক্ষার্থী দিয়া সিদ্দিকী বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পেয়েছেন জিপিএ-৫।

আরও পড়ুন

মেয়ে চিকিৎসক হবে, সেই স্বপ্নই একসময় দেখতেন বাবা নূর আলম সিদ্দিকী। এ জন্য মেয়েকে বিজ্ঞান বিভাগে পড়তে উৎসাহ দিয়েছেন। কিন্তু চিকিৎসক হওয়ার জন্য যতটা পড়াশোনা করা প্রয়োজন, ততটা সময় দেওয়া দিয়ার জন্য একটু কঠিনই বলা যায়। ভোরের আলো ফোটার আগেই ঘুম থেকে উঠতে হয়। টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ স্টেডিয়ামে জাতীয় দলের ক্যাম্পে জার্মান কোচ মার্টিন ফ্রেডরিখের অধীনে চলে কঠোর অনুশীলন। সকালে ও বিকেলে দুই বেলা অনুশীলনের পর চুম্বকের মতো শরীরটাকে টানতে থাকে বিছানা। কিন্তু খেলার মাঠ দিয়াকে যতটা টানে, ততটাই টানে পড়ার টেবিল। ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার ব্যস্ত সূচি সামলে পড়াশোনাটা তাই ঠিকই করে গেছেন মনোযোগ দিয়ে।

দিয়া সিদ্দিকী
ছবি: সংগৃহীত

ভালো ফলের চ্যালেঞ্জটা নিতে বেশ কষ্টই হতো দিয়ার। বলছিলেন, ‘যখন সময় পেয়েছি, তখনই পড়েছি। একটু কষ্ট হয়েছে। কিন্তু প্রতিটি বিষয় মনোযোগ দিয়ে পড়েছি। বিজ্ঞানের ছাত্রী বলে পদার্থবিজ্ঞান আর রসায়নের জন্য বাড়তি প্রাইভেট পড়তে হয়েছে। তবে জীববিজ্ঞান পড়েছি নিজে নিজে।’

সারা দিনের অনুশীলনের পর অনেক সময় বীজগণিতের সূত্রের মারপ্যাঁচ, ইংরেজি ব্যাকরণ মাথায় ঢুকতে চাইত না। তখন? ‘অনেক সময় এমন হয়েছে, কঠোর অনুশীলন শেষে কিছুতেই ভালোমতো মনোযোগ দিতে পারতাম না। কিন্তু নিজের সঙ্গেই লড়াইটা হতো। নিজেকে বলতাম, যেভাবেই হোক আমাকে ভালো ফল করতেই হবে।’

দিয়ার এমন ফলে পরিবারের সবাই আনন্দিত। উচ্ছ্বসিত দিয়া বলছিলেন, ‘বেশি খুশি হয়েছেন আমার আব্বু ও আম্মু। কারণ, তাঁরা চাইতেন, আমি যেন ডাক্তার হই। খেলাধুলায় এসে তাঁদের সেই স্বপ্ন পূরণ করতে পারিনি। এবার জিপিএ-৫ পেয়ে তাঁদের মুখে হাসি ফুটিয়েছি।’

দিয়া সিদ্দিকী
ছবি: প্রথম আলো

বিদেশে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট খেলতে যেতে হয় বলে মাঝেমধ্যেই বেশ সমস্যায় পড়তে হয়েছে এই আর্চারকে। কিন্তু তারপরও অনুশীলন ও প্রতিযোগিতার পাশাপাশি পড়াশোনার ক্ষতি যতটা সম্ভব পুষিয়ে নিতে চেষ্টা করেছেন দিয়া। বলছিলেন, ‘দেশের বাইরে খেলতে গেলে পড়াশোনার কোনো সুযোগ থাকে না। কিন্তু দেশে ফিরে সেটা পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। পড়াশোনায় আমার ক্লান্তি নেই। একটু কষ্ট হলেও অনুশীলনের পর পড়তে বসি। আমার এত দিনের পরিশ্রমের ফল পেয়েছি। খুবই ভালো লাগছে।’

পরীক্ষার ফল পেয়েই সবার আগে নীলফামারীতে বাবাকে জানিয়েছেন দিয়া। কিন্তু খুশির খবর পরিবারের সবার সঙ্গে মিলে ভাগাভাগি করার সুযোগ আপাতত হচ্ছে না। আগামী মাসে এশিয়া কাপ স্টেজ ওয়ান টুর্নামেন্টে খেলতে চীনা তাইপেই যাবেন। এ জন্য জুনিয়র র‍্যাঙ্কিংয়ের বাছাইয়ে অংশ নিতে হবে। দিয়া বলেন, ‘আমি চেয়েছিলাম, কাল বাড়িতে যাব। কিন্তু র‍্যাঙ্কিং টুর্নামেন্টের ট্রায়ালের কারণে হয়তো যাওয়া হবে না। এবার পুরোদমে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিতে চাই।’

দিয়ার প্রথম পছন্দ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক করতে চান তিনি। এরই মধ্যে ভর্তি কোচিংও শুরু করে দিয়েছেন। কদিন আগে তীর-প্রথম আলো বর্ষসেরা ক্রীড়া পুরস্কারে ২০২১ সালের বর্ষসেরা নারী ক্রীড়াবিদ হয়েছেন। ২০২১ সালে টোকিও অলিম্পিকের আর্চারিতে রিকার্ভের মিশ্র ইভেন্টে রোমান সানার সঙ্গে জুটি গড়ে চূড়ান্ত পর্বে খেলেন দিয়া।

খেলোয়াড়দের জন্য পড়াশোনাটা যে কতটা জরুরি, সেটা তাঁর ভালোই জানা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ক্যারিয়ার শেষে খেলোয়াড়দের সেভাবে মূল্যায়ন হয় না। দিয়া তাই খেলোয়াড়ি সত্তার পাশাপাশি একাডেমিক লেখাপড়াকেও বেশ গুরুত্ব দেন। হোক খেলা কিংবা পড়া, লড়াকু মনোভাবই বোধ হয় তাঁকে এগিয়ে রাখে।