অন্যের বাড়িতে গিয়ে যেসব জিনিসে হাত দেওয়া মানেই অভদ্রতা
প্রতিটি বাড়িতেই এমন কিছু জিনিস থাকে, যা স্বাস্থ্যবিধি বা ব্যক্তিগত রুচির কারণে অনুমতি ছাড়া স্পর্শ করা অনুচিত। তাই ভালো অতিথি হতে কিংবা ছোট হতে না চাইলে কিছু অলিখিত নিয়ম মেনে চলা জরুরি। চলুন, জেনে নেওয়া যাক অন্যের বাড়িতে গেলে কোন কোন জিনিসে হাত দেওয়া উচিত নয়।
বই, ডায়েরি ও ফটো অ্যালবাম
আপনি বইপ্রেমী হলে অন্যের বাড়িতে গিয়ে বইয়ের তাক দেখলে নিশ্চয়ই চোখ চকচক করে ওঠে। কিন্তু মনে রাখবেন, বই একজন ব্যক্তির রুচি ও ব্যক্তিত্বের পরিচয় বহন করে।
তাই অনুমতি ছাড়া অন্যের বইয়ের তাকে হাত দেওয়া বা বই টেনে দেখা অভদ্রতা। এমনকি বসার স্থানে যদি কোনো বই থাকে এবং তাতে যদি কোনো বুকমার্ক দেওয়া থাকে, তাতেও হাত দেওয়া উচিত নয়। যদি কোনো বই আপনার আগ্রহ তৈরি করে, তাহলে সরাসরি বাড়ির কারও অনুমতি নিয়ে সেটি দেখতে বা পড়তে পারেন।
বসার জায়গার আশপাশে অনেক সময় ডায়েরি বা ব্যক্তিগত জার্নাল থাকে। ডায়েরি একজন ব্যক্তির অত্যন্ত ব্যক্তিগত ও স্পর্শকাতর জিনিস। এর মধ্যে থাকে লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত চিন্তা, অনুভূতি ও গোপন কথা।
তাই অন্যের ডায়েরি দেখলে হাত দেওয়ার মতো ভুল করবেন না। কারণ, এটি অন্যের বিশ্বাস ও গোপনীয়তার প্রতি চরম অসম্মান।
ফটো অ্যালবামও একজন ব্যক্তি ও তাঁর পরিবারের একান্ত ব্যক্তিগত স্মৃতি জমানোর জায়গা। এতে এমন অনেক মুহূর্তের ছবি থাকতে পারে, যা তিনি সবার সঙ্গে ভাগ করে নিতে চান না।
তাই অনুমতি ছাড়া ছবির অ্যালবাম খুলে দেখা অনুচিত। বাড়ির কেউ যদি আপনাকে তাঁদের পুরোনো স্মৃতি দেখাতে চান, তাহলে তাঁরা নিজেই অ্যালবামটি নিয়ে আসবেন এবং ছবির পেছনের গল্পগুলো বলবেন।
ফ্রিজ ও রান্নাঘরের ক্যাবিনেট
হয়তো ভীষণ গরমে যানজট ঠেলে অন্যের বাড়িতে গেছেন, স্বাভাবিকভাবেই আপনার তেষ্টাও পেয়েছে খুব। আর হাতের কাছেই দেখলেন ফ্রিজ। তখন কি বাড়ির মালিকের অনুমতি ছাড়াই সরাসরি ফ্রিজ খুলে বসবেন? না।
মনে রাখবেন, ফ্রিজ বাড়ির লোকজনের একান্ত ব্যক্তিগত ভান্ডার। এটা কোনো ‘পাবলিক স্টোর’ নয়।
একই কথা রান্নাঘরের ক্যাবিনেট বা ড্রয়ারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কিছু দরকার হলে বিনয়ের সঙ্গে চেয়ে নিন। এতে আপনার প্রতি বাড়ির বাসিন্দাদের সম্মান বাড়বে।
টিভি ও এসির রিমোট
অন্যের বাড়িতে গিয়ে চাইলেই টিভির রিমোট হাতে নিয়ে বসে পড়তে পারেন না। বাড়ির মালিকের অনুমতি ছাড়া টিভি চালানো বা চ্যানেল বদলানোর জন্য রিমোট হাতে নেওয়া অভদ্রতা। যদি কোনো কিছু দেখতে চান, তাহলে সৌজন্যতার সঙ্গে অনুমতি চেয়ে নিন।
আর বাড়ির মালিক যদি আপনাকে হাতে রিমোটটা তুলে দেন, তাহলে ইউটিউব বা নেটফ্লিক্স দেখার সময় তাঁদের ব্যক্তিগত প্রোফাইল ব্যবহার না করে ‘গেস্ট মোড’ ব্যবহার করুন।
একইভাবে বাইরে থেকে এসে গরম লাগলেও নিজে থেকে এসির রিমোটে হাত দেবেন না। কারণ, ঘরের তাপমাত্রা কমানো বা বাড়ানোর অধিকার বাড়ির মালিকের। এসি চালু করার অধিকার তাঁদের হাতেই থাকুক। তা ছাড়া বিদ্যুৎ বিল কিন্তু তাঁদেরই দিতে হবে।
চার্জিং পয়েন্ট
অন্যের বাড়ি গিয়ে আপনার ফোনের চার্জ হয়তো প্রায় শেষ। তবে হাতের কাছে চার্জার ও প্লাগ পয়েন্ট দেখেই ঝট করে নিজের ফোন চার্জ করতে দেবেন না। কারণ, সেই পয়েন্টে হয়তো ল্যাপটপ বা রাউটারের মতো জরুরি কোনো যন্ত্র লাগানো আছে। যা হয়তো আপনার চোখ এড়িয়ে গেছে।
তার চেয়ে বরং বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করে নিন, কোথাও চার্জ করার সুযোগ আছে কি না। এতে আপনার ভদ্রতা প্রকাশ পাবে।
বাথরুম ও ব্যক্তিগত পরিচর্যার জিনিসপত্র
বাথরুমে গিয়েও কিছু নিয়ম মেনে চলা জরুরি। সেখানে রাখা অন্যের টুথব্রাশ, ফেসওয়াশ, শ্যাম্পু, সাবান কিংবা রেজর ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। এসব জিনিস একান্ত ব্যক্তিগত এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্পর্শ করা উচিত।
যদি আপনার কোনো কিছুর প্রয়োজন হয়, তবে সংকোচ না করে বাড়ির বাসিন্দাদের জিজ্ঞেস করে নিন। আর বাথরুমের কোনো কিছু সম্পর্কে যদি আপনার পরিষ্কার ধারণা না থাকে; যেমন কমোড ব্যবহারের পদ্ধতি বা ট্যাপের কাজ, তবে না বুঝে হাতাহাতি করবেন না।
এতে অপ্রয়োজনীয় জটিলতা বা জিনিস নষ্ট হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে পারে। কোনো কিছু জানতে হলে বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করে নেওয়াই ভালো।
কম্পিউটার, ল্যাপটপ ও ফোন
অন্যের বাড়িতে আপনার সামনে ল্যাপটপ, কম্পিউটার বা মুঠোফোন থাকতেই পারে। তার মানে এই নয় যে এসব সবার ব্যবহারের জন্য। এসব জিনিস বাড়ির মালিকের একান্ত ব্যক্তিগত ডিজিটাল স্পেস। যেখানে তাঁর সব ব্যক্তিগত এবং পেশাদার জীবনের তথ্য সংরক্ষিত থাকে।
এসব কোনো ইন্টারনেট ক্যাফের জিনিস নয় যে আপনি চাইলেই ব্যবহার করতে পারেন। এতে তাঁদের ব্যক্তিগত ছবি, গুরুত্বপূর্ণ কাজ বা অন্যান্য স্পর্শকাতর তথ্য থাকতে পারে।
যদি কোনো কিছু দেখার বা ইন্টারনেটের প্রয়োজন হয়, তাহলে সরাসরি অনুমতি নিতে ভুলবেন না। কম্পিউটার, ল্যাপটপ বা ফোন ব্যবহারের প্রয়োজন হলেও অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা উচিত।
গাছ ও পোষা প্রাণী
অনেকের বাড়িতেই সুন্দর বাগান বা পোষা প্রাণী থাকে। কিন্তু মনে রাখবেন, অনুমতি ছাড়া গাছের কোনো পাতা ছেঁড়া, ফুল তোলা কিংবা চারা গাছ তুলে নেওয়া একেবারেই ঠিক নয়। কারণ, বাগান একজন ব্যক্তির ভালোবাসার জায়গা, যা অনেক যত্ন করে তৈরি করা হয়।
একই কথা পোষা প্রাণীর ক্ষেত্রেও মনে রাখতে হবে। আপনি পোষা প্রাণীর স্বভাব সম্পর্কে জানেন না। তাই নিজে থেকে এদের স্পর্শ করতে যাবেন না। কারণ, অনেক প্রাণী নতুন মানুষের স্পর্শে অস্বস্তিবোধ করে।
ওষুধের বাক্স ও বিলের কাগজপত্র
কারও বাসায় গেলে তাঁর ব্যক্তিগত ওষুধের বাক্সে হাত দেবেন না। কারণ, বাক্সের ওষুধগুলো তাঁর এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্যের সঙ্গে যুক্ত ও স্পর্শকাতর। যদি কোনো ওষুধের প্রয়োজন হয়, তবে সরাসরি বলুন। তিনি নিজেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।
আর টেবিল বা ড্রয়ারে রাখা বিল বা অন্যান্য ব্যক্তিগত কাগজপত্র স্পর্শ করা একেবারেই উচিত নয়। এসবের মধ্যে আর্থিক বা অন্য কোনো গোপন তথ্য থাকতে পারে, যা দেখা আপনার জন্য যেমন অপ্রয়োজনীয়, তেমনি বাড়ির মালিকের জন্য বিব্রতকর।
আরও দুটি বিষয়
অনুমতি নিয়ে অন্যের বাড়িতে ঢোকা
বাড়ির বাসিন্দাদের সঙ্গে আপনার যতই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকুক না কেন, কোনো ব্যক্তির বাড়িতে গেলে অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করা উচিত নয়। কারণ, এটি একটি সাধারণ শিষ্টাচার।
বাড়িতে গিয়ে কেবল দরজায় টোকা দিতে পারেন অথবা কলবেল বাজাতে পারেন। বাড়ির দরজা খোলা থাকলেও নিজে থেকে ভেতরে প্রবেশ করবেন না। কারণ, বাড়ির বাসিন্দারা হয়তো কোনো কাজে ব্যস্ত বা অপ্রস্তুত অবস্থায় আছেন। যতক্ষণ না আপনাকে ভেতরে আসতে বলছেন, ততক্ষণ বাইরে অপেক্ষা করুন।
আর অবশ্যই নির্ধারিত সময়ের আগে পৌঁছাবেন না। কারণ, আতিথেয়তার সব প্রস্তুতি শেষ হওয়ার আগেই উপস্থিত হলে আমন্ত্রণকারীদের ওপর অপ্রয়োজনীয় চাপ তৈরি হতে পারে।
ঘরে ঢোকার পর চুপচাপ একটা নির্দিষ্ট জায়গায় অপেক্ষা করুন, যতক্ষণ না বাড়ির বাসিন্দারা আপনাকে বসার জায়গা দেখিয়ে দেন বা আপ্যায়ন শুরু করেন।
অন্যের বাড়ি গিয়ে উঁকিঝুঁকি দেওয়াও ভীষণ দৃষ্টিকটু। বিশেষ করে ব্যক্তিগত বাথরুম ও বেডরুম। এই দুটো জায়গায় কখনোই উঁকিঝুঁকি দেবেন না এবং বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করবেন না।
জুতা খুলে ঘরে ঢোকা
আমাদের দেশে অধিকাংশ বাড়িতে জুতা পরে ঘরে ঢোকার চল নেই। এটা বেয়াদবি ও অভদ্রতা হিসেবে দেখা হয় অনেক বাড়িতে।
তাই অন্যের বাড়িতে গিয়ে দরজার মুখে জুতা খুলে প্রবেশ করুন।
আরও ভালো হয় যদি ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে হাত ধুয়ে নেন, প্রয়োজনে পা ধুয়ে ফেলাও খুব ভালো।
জুতা খুলে কোথায় রাখবেন, তা–ও ঘরে ঢোকার আগে জিজ্ঞেস করে নেওয়া ভালো। মনে রাখা জরুরি, সোফা বা টেবিলে পা তুলে বসা একেবারেই অনুচিত।
সূত্র: রিডার্স ডাইজেস্ট ও ইয়াহু