অফিসে প্রেম করার আগে জেনে রাখুন

সহকর্মীর সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে অফিসের নীতিমালা জেনে নিনমডেল: শামস ও নাজমি। ছবি: সুমন ইউসুফ

আমরা যাঁরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করি, তাঁদের দিনের বড় একটি অংশ সহকর্মীদের সঙ্গেই কাটে। আসা–যাওয়া আর ঘুমের সময়টুকু বাদ দিলে দেখা যাবে, পরিবারের সদস্যদের চেয়ে তাঁদের সঙ্গেই কাটছে বেশি সময়। স্বাভাবিকভাবেই সহকর্মীদের সঙ্গে একধরনের সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়, তাঁরা হয়ে ওঠেন বন্ধু, মনের কথা ভাগ করে নেওয়ার সঙ্গী। কখনো কখনো এই সম্পর্ক পেশাগত সীমারেখাও ছাড়িয়ে যায়।

প্রশ্ন হলো, সহকর্মীদের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে এই সীমারেখা কোথায় টানতে হবে? অফিসে বা বাইরে বিপরীত লিঙ্গের সহকর্মীর সঙ্গে কোন কথাটা বলা যাবে, কোন ঠাট্টাটা করা যাবে, মোটের ওপর কতটা মেলামেশা করা যাবে?

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে কোল্ডপ্লের কনসার্ট দেখতে গিয়ে অন্তরঙ্গ অবস্থায় ক্যামেরায় ধরা পড়েন মার্কিন সফটওয়্যার সংস্থা অ্যাস্ট্রোনোমার প্রধান নির্বাহী অ্যান্ডি বায়রন ও সংস্থাটির এইচআর প্রধান ক্রিস্টিন ক্যাবট। যাঁদের দুজনেরই রয়েছে আলাদা পরিবার। তাঁদের সম্পর্কের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসতেই অফিসের ক্ষেত্রে সহকর্মীর সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হবে, একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিদের মধ্যের সম্পর্ক নৈতিকতার কোন মানদণ্ড মেনে চলবে, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।

সহকর্মীর সঙ্গে কেমন আচরণ করবেন সেসব নিয়ে প্রতিটি ভালো অফিসেই আচরণবিধি থাকে
মডেল: শামস ও নাজমি। ছবি: সুমন ইউসুফ

এসব নিয়েই মানবসম্পদবিষয়ক পেশাজীবী আরিফ শাহরিয়ারের সঙ্গে কথা হলো। দীর্ঘদিন দেশের বেশ কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানে মানবসম্পদ বিভাগের দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। বর্তমানেও তিনি একটি বড় প্রতিষ্ঠানে মানবসম্পদ বিভাগে কর্মরত। তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, সহকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হবে বা নারী কর্মীদের সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হবে, সে বিষয়ে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার কোনো নিয়ম-নীতি আছে কি না।

জবাবে আরিফ শাহরিয়ার বলেন, একটি ভালো প্রতিষ্ঠানে অবশ্যই এসব বিষয়ে নির্দিষ্ট আচরণবিধি থাকতে হবে। সাধারণত এ নিয়ম বা আচরণবিধি তৈরি করে মানবসম্পদ বিভাগ। প্রতিষ্ঠান কী চায়, প্রতিষ্ঠান কেমন সংস্কৃতিতে চলবে, সেখানে কেমন কর্মপরিবেশ গড়ে তোলা হবে, তার সবকিছুই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে তৈরি করা হয়।

সেই নিয়মের মধ্যেই থাকবে—আপনি আপনার সহকর্মীর সঙ্গে কেমন আচরণ করবেন, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হলে তা কতটুকু হবে কিংবা নারী-পুরুষনির্বিশেষ সবার সঙ্গে আপনার আচরণ কেমন হবে। এমনকি এই আচরণবিধি মেনে না চললে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সেটিও স্পষ্ট করা থাকে।

এই মানবসম্পদ পেশাজীবী আরও বলেন, যখন কোনো পদের জন্য কর্মী নিয়োগ করা হয়, তখন শুধু যে তাঁর দক্ষতা দেখা হয়, তা নয়; তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের সংস্কৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে মানানসই হবেন কি না, তাঁর মূল্যবোধ আর প্রতিষ্ঠানের মূল্যবোধ মিলবে কি না, সে বিষয়েও খেয়াল রাখা হয়।

আরও পড়ুন

অনেক সময় দেখা যায়, একই অফিসে কাজ করতে করতে দুজন সহকর্মী প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন, সে ক্ষেত্রে তাঁদের কী করা উচিত? আর এ ক্ষেত্রে অফিসের অবস্থান কী হবে, জানতে চাইলে এই মানবসম্পদ পেশাজীবী বলেন, ‘প্রেম তো একেবারে ব্যক্তিগত বিষয়। সেখানে আসলে অফিসের কিছু বলার থাকে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না ওই সম্পর্ক অফিসের কাজে প্রভাব ফেলে।

ব্যক্তিগত সম্পর্ক যেন কর্মক্ষেত্রে পেশাগত সম্পর্ককে ছাপিয়ে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখুন
মডেল: শামস ও নাজমি। ছবি: সুমন ইউসুফ

অর্থাৎ আপনাকে কর্মক্ষেত্রের নিয়ম মেনে চলতে হবে। ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলো যেন ব্যক্তিগতই থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ ব্যক্তিগত সম্পর্ক অফিসকে বিপদে না ফেললে সেটি ততক্ষণ পর্যন্ত স্বাভাবিক হিসেবেই ধরা হয়।

অনেক অফিসেই স্বামী-স্ত্রী বা ভাই-বোন কাজ করতে পারেন; কিন্তু তাঁদের মধ্যে রিপোর্টিং রিলেশন থাকে না। সাধারণত তাঁরা দুই বিভাগে বা দুই জায়গায় কাজ করেন। এটিও খেয়াল রাখতে হয় যে তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক যেন কর্মক্ষেত্রে পেশাগত সম্পর্ককে ছাপিয়ে না যায়।

প্রত্যেককেই তাঁর নিজের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে। মোটকথা, প্রেম–বিয়ের সম্পর্কই হোক; আর আত্মীয়তা—তা যেন কর্মক্ষেত্র, পেশাদারত্ব বা দায়িত্বের মধ্যে বাধা সৃষ্টি না করে।

কোল্ডপ্লের কনসার্টে অ্যাস্ট্রোনোমার প্রসঙ্গ টেনেই জানতে চাই, ঊর্ধ্বতন কর্তা যদি তাঁর অধীন কোনো কর্মীকে অনৈতিক সম্পর্কের প্রস্তাব দেন, অথবা যদি তাঁরা দুজনের সম্মতির ভিত্তিতেও সম্পর্কে জড়ান, সে ক্ষেত্রে তা জানার পর অফিসের কী ভূমিকা হবে?

এ প্রসঙ্গে আরিফ শাহরিয়ার বলেন—প্রথমত, যদি কোনো নারী যৌন নিপীড়নের শিকার হন, তাহলে সেটির জন্য বেশির ভাগ ভালো প্রতিষ্ঠানে আলাদা নীতিমালা থাকে। সেই নীতিমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে আমরা বলি, নিয়ম অনুযায়ী অভিযোগ করতে। অভিযোগ দিলেই তখন মানবসম্পদ বা প্রশাসন বিভাগ পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে পারে।

আরও পড়ুন

আবার যদি পরস্পরের সম্মতির ভিত্তিতে সম্পর্ক হয়; আর সেটির নেতিবাচক প্রভাব কাজের ওপর না পড়ে, তাহলে অফিসের কিছু করার থাকে না। কেউ যদি ওই সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে স্বজনপ্রীতি করেন বা অফিসের মধ্যে এমন কোনো আচরণ করেন, যা শোভন নয়, তখন ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।

আবার তাঁদের সম্পর্কের বিষয়ে কেউ যদি অভিযোগ করেন, তাহলে সুনির্দিষ্ট প্রমাণসাপেক্ষে পদক্ষেপ নেওয়া হয়। আমাদের দেশের করপোরেট হাউসগুলোয় এ–সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকে বলেও জানান আরিফ শাহরিয়ার।

কর্মস্থলকে একজন কর্মজীবী মানুষের জন্য পবিত্র স্থান হিসেবে উল্লেখ করলেন মানবসম্পদ উন্নয়নবিষয়ক প্রতিষ্ঠান করপোরেট কোচের মুখ্য পরামর্শক যিশু তরফদার। তাঁর মতে, যে স্থান থেকে অন্নের সংস্থান হয়, সেখানে এমন কোনো কাজ করা উচিত নয়, যা নৈতিকতার মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

যিশু তরফদার বলেন, ‘বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, আমরা পরিবারের সদস্যদের চেয়ে সহকর্মীদের সঙ্গে বেশি সময় কাটাচ্ছি। তাঁদের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও একধরনের আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়। ফলে তাঁদের প্রতিও আমাদের কিছু দায়িত্ব থাকে। সেই সম্পর্কের মধ্যে এমন কোনো কিছু করা যাবে না, যা অস্বস্তি তৈরি করে।’

তবে কাজ করতে গিয়ে দুজন সহকর্মীর মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠতেই পারে। এ ক্ষেত্রে যিশু তরফদারের পরামর্শ, যেকোনো একজনের উচিত ওই কর্মক্ষেত্র ছেড়ে যাওয়া। এতে কাজের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না, ব্যক্তিগত সম্পর্কও সুন্দর থাকবে। সহকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিজের সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান প্রয়োগের পরামর্শ দিলেন এই প্রশিক্ষক।

সবারই উচিত, যাঁর যাঁর অবস্থান থেকে অফিসের কোড অব কন্ডাক্ট মেনে চলা। অফিসে নিজের কাজগুলো ঠিকমতো করলে আর কোনো অনিয়মে না জড়ালে অফিসও আপনাকে মাথায় তুলে রাখবে।

যদি সম্পর্কটি টিকিয়ে রাখতে চান

অফিসের সহকর্মীর সঙ্গে প্রেমের ক্ষেত্রে মার্কিন ক্যারিয়ার বিশেষজ্ঞ ভিকি সালেমি এক নিবন্ধে বলেন, ‘যখন বুঝবেন অফিসের মানবসম্পদ বিভাগকে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পর্কের কথা জানাতে হবে বা আপনাদের একজনকে অফিস বদলাতে হতে পারে, তখন সম্পর্কটা নিয়ে আরও গুরুত্ব দিয়ে ভাবুন। এই ভাবনা থেকেই সিদ্ধান্তটা আসবে, সম্পর্কটা আসলে ঝুঁকি নেওয়ার মতো কি না।’

যদি মনে করেন সম্পর্কটি আপনারা টিকিয়ে রাখতে চান, তাহলে আরও কিছু বিষয় খেয়াল রাখুন। এই যেমন সহকর্মীদের জানিয়ে দিন আপনাদের প্রেমের কথা। কিন্তু সম্পর্ক নিয়ে খোলামেলা সব আলোচনা করতে যাবেন না।

আপনি যদি পুরোপুরি গোপনীয়তা বজায় রাখতে না পারেন (বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে), তাহলে আপনাদের সম্পর্ক নিয়ে নানা রকম গুজব ছড়াতে থাকবে। চাকরির সুবাদে না চাইলেও শেষ পর্যন্ত সহকর্মীরা বিষয়টি জেনে যাবেন। তাই কানাঘুষা চলার আগে নিজেরাই সেটা জানিয়ে একটা সীমা নির্ধারণ করে দিতে পারলে ভালো হয়।

আরও পড়ুন