রেস্তোরাঁ বা শপিং মলে কেন গান বাজানো হয় জানেন?

রেস্তোরাঁয় গান বাজলে ক্রেতারা সহজে সেই জায়গার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেন। মডেল: গালিব ও সামিয়া
ছবি: সুমন ইউসুফ

কোনো রেস্তোরাঁ বা মলে ঢুকলে অজান্তেই হয়তো আপনার হাত–পা বা শরীর দুলে ওঠে। খেয়াল করে দেখবেন যে দোকানে বা রেস্তোরাঁয় গান বাজানো হচ্ছে, সাধারণত সেখানেই এটা হয় বেশি। গানের এমনই ক্ষমতা যে কোনো অপরিচিত পরিবেশে পছন্দের গান বাজলে আমরা সহজেই সেই পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারি। তাই আজকাল রেস্তোরাঁ বা শপিং মলগুলো তাদের জনপ্রিয় প্লে লিস্ট থেকে একেক পর এক গান বাজাতে থাকে।

বিভিন্ন গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্য জানলে আরও অবাক হবেন। গবেষকেরা প্রমাণ পেয়েছেন, এই গানের সঙ্গে বেচাবিক্রিরও দারুণ সম্পর্ক আছে। দেখা যাচ্ছে, যেসব শপিং মল বা দোকানে হালকা ভলিউমে আনন্দদায়ক বা রোমান্টিক গান বাজানো হয়, সেখানে ক্রেতারা বেশি আকৃষ্ট হন। ক্রেতারা নিজেদের পরিচিত গানের সঙ্গে অবচেতনে নিজেকে জড়িয়ে নেন আর বেশি সময় সেখানে অবস্থান করেন। যার কারণে বেশি জিনিস কিনতে আগ্রহী হন।

যেসব দোকানে গান বাজানো হয়, সেখানে ক্রেতারা বেশি আকৃষ্ট হন। মডেল: ললনা ও নীল
ছবি: কবির হোসেন

বিভিন্ন ব্র্যান্ডের দোকানে গান বাজানোর আরেকটা দিক হলো নিজেদের উপস্থিতি জানান দেওয়া। বিবিসির এক প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বখ্যাত স্পোর্টস শপ ‘অ্যাডিডাস’ নিজেদের দোকানগুলোতে সংগীত পরিচালনার জন্য বিশেষ একটি কোম্পানিকে দায়িত্ব দেয়, এরা অ্যাডিডাসের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বাজারে প্রচলিত নয় এমন কিছু মিউজিকের তালিকা করে দেয়।

আরও পড়ুন

এ ছাড়া বিভিন্ন হোটেল, শপ, রেস্তোরাঁ বা স্পা সেন্টারে সংগীতকে বিশেষভাবে হাইলাইট করা হয়, যেন সেখানে আসা ক্রেতা বা সেবাগ্রহীতা আরও বেশি সময় ধরে থাকেন। বাংলাদেশে আজকাল আধুনিক পোশাকের ব্র্যান্ডগুলোতে প্রায়ই হিপহপ, পপ বা নাচের রিদমযুক্ত গান বেশি চালাতে দেখা যায়। আর রেস্তোরাঁ বা কফিশপগুলোতে দেশি-বিদেশি ধাঁচের রোমান্টিক গান চলে বা সরাসরি গান গাওয়া হয়। আবার অভিজাত দোকানগুলোতে (জুয়েলারি, পারফিউম অথবা লাক্সারি বুটিক শপ) জ্যাজ, ক্ল্যাসিক্যাল বা সেমি ক্ল্যাসিক্যাল, ইনস্ট্রুমেন্টাল মিউজিকগুলো বেশি জনপ্রিয়, কেননা এসব দোকানে একটু উচ্চশ্রেণির লোকজন আনাগোনা করেন।

রেস্তোরাঁর গমগমে পরিবেশ, আড্ডা-হইচই এড়িয়ে পছন্দের গানে মগ্ন হয়ে যেতেও মিউজিক ভালো কাজ করে।
ছবি: কবির হোসেন

শপিং মল বা রেস্তোরাঁগুলো মিউজিক বাজানোর সময় চারটি জিনিস মাথায় রাখে

মুড: গান শুনলে আমাদের স্ট্রেস হরমোন কমে যায়; আর প্রিয় গানগুলো আমাদের মনের অজান্তেই মন ফুরফুরে করে তোলে। তখন শপিং মলের দীর্ঘ এক সারি থেকে অন্য সারিতে যেতে বা রেস্তোরাঁয় অপেক্ষা করতে ক্লান্ত লাগে না। কম লোকজনই বোর হন; কারণ, পছন্দের গানের তালে ছন্দে বিভোর থাকেন। অনেকে আবার একান্ত নিজেকে সময় দিতে ভালোবাসেন; রেস্তোরাঁর গমগমে পরিবেশ, আড্ডা-হইচই এড়িয়ে পছন্দের গানে মগ্ন হয়ে যেতেও মিউজিক ভালো কাজ করে।

জনরা বা টাইপ: কোন স্টোরে কোন ধরনের গান বাজানো হচ্ছে, তা কিন্তু স্টোরটির ব্যাপারে ক্রেতাদের একটা পূর্বধারণা দিয়ে দেয়। অনেকটা অন্দরসজ্জার মতো। বর্তমানে দেশি–বিদেশি নামকরা ব্র্যান্ডগুলো তাদের দোকানে কেমন গান চালানো হবে, সেটা ঠিক করে সুনির্দিষ্ট ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে। আন্তর্জাতিকভাবে তো এই গান ঠিক করার জন্য অনেক প্রতিষ্ঠান মিউজিক কোম্পানি বা কম্পোজারদের নিয়োগ দিচ্ছে। এতে ব্র্যান্ডের বৈশিষ্ট্যও সমুন্নত থাকে, সঙ্গে ক্রেতারা সেসব গান দিয়ে ব্র্যান্ডগুলোতে সহজে আলাদা করতে পারেন। আর বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ওয়ালমার্ট তো নিজেদের আলাদা রেডিও–ই চালু করে রেখেছে।

টেম্পো বা তাল: গানের তালে তালে চলা আমাদের অভ্যাস। আর সে সুযোগটাই কাজে লাগানো হয় দোকানগুলোতে। দেখা যায়, রেস্তোরাঁ বা কফিশপগুলো যখন খোলা হয়, ধীর তালের কিছু গান বা মিউজিক বাজে, যেন দিনের শুরুটা প্রশান্তির হয়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গানের টেম্পোও পাল্টে যায়। আর ক্লোজিং টাইমের আগে ক্রেতাদের দ্রুত খেতে বা কেনাকাটার তাড়া দেওয়ার জন্য (স্টাফদের ক্লান্তি কাটাতেও) দ্রুত তালের হিপহপ, ক্ল্যাসিক রক বা পপ বাজানো হয়।

সাউন্ড: ভলিউম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রেস্তোরাঁ বা শপিং মলের সব জায়গায় যেন মডারেট ভলিউমে গান চলে, সেটা নিশ্চিত করতে আগে চাই ভালো সাউন্ড সিস্টেমের ব্যবস্থা। শুধু ক্রেতা আকৃষ্ট করতে রুচিহীন গান উচ্চ শব্দে বাজালে হবে না; এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। সারা দিন দোকানে কাজ করা কর্মীরাও বিরক্ত হয়ে যান। তাই শব্দ এমনভাবে শোনা যেতে হবে, যেন ক্রেতা গান উপভোগ করার সঙ্গে সঙ্গে পুরো জায়গাটা ঘুরে দেখেন। এতে জেনেবুঝে বা অজান্তেই তিনি কিনতে উদ্বুদ্ধ হন, আর না কিনলেও পরিবেশ পছন্দ করে প্রতিষ্ঠানের সুনাম বাড়াতে কাজ করেন। রেস্তোরাঁর ক্ষেত্রেও তা–ই; পছন্দের গানে মন স্বতঃস্ফূর্ত থাকলে খাবারের অর্ডারও বেড়ে যায়।

আজকাল মানুষের অবসর খুব কম। তাই ভালো রেস্তোরাঁ বা শপিং মলে কেনাকাটা ছাড়াও মানুষ বেশি সময় কাটাতে চান। আর এ সময় যদি আপনার প্লে লিস্টের থাকা প্রিয় গানটি বেজে ওঠে, অবশ্যই আপনি উচ্ছ্বসিত হবেন।

সূত্র: বিবিসি

আরও পড়ুন