ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জিনিস নিয়ে বড় গবেষণা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ল্যাবে
সারা পৃথিবীতেই ‘ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রযুক্তি’ বা ন্যানো টেকনোলজির রাজত্ব চলছে। এই প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে কীভাবে মানুষের জীবন আরও সহজ করা যায়, তা নিয়ে কাজ চলছে বিশ্বের বহু গবেষণাগারে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বায়ো অ্যান্ড ন্যানো টেকনোলজি রিসার্চ ল্যাবরেটরি’ও এমনই এক গবেষণাকেন্দ্র। শিক্ষার্থীরা এখানে বিভিন্ন ধরনের ম্যাটাইল অক্সাইড ও ন্যানোপার্টিকেল (একটি ক্ষুদ্র কণা, যার আকার ১-১০০ ন্যানোমিটারের মধ্যে। ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস, চিকিৎসা ও কৃষি খাতে এটি ব্যবহার করা হয়) তৈরি করেন। এই ল্যাবে কাজ করা অনেক শিক্ষার্থীই পূর্ণ বৃত্তিসহ ভিনদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন।
২০২১ সালে ল্যাবটি প্রতিষ্ঠা করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক আনোয়ারুল কবির ভূঁইয়া। তিনি বলেন, ‘২০১৩ সালে আমি জাপানের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করি। তখন মনে হয়েছে, জাপানের ল্যাবগুলোতে যেভাবে কাজ করেছি, যে সুযোগ-সুবিধা পেয়েছি, তা যদি আমি আমার দেশে পেতাম বা আমার শিক্ষার্থীরা পেত, তাহলে খুব ভালো হতো। এমন একটি ভাবনা থেকেই ল্যাবটি প্রতিষ্ঠা করা। এই ল্যাবে ন্যানোটেকনোলজি ব্যবহার করে বাংলাদেশে চিকিৎসা, পরিবেশ, কৃষি খাতে যে সমস্যাগুলো আছে, সেগুলো সমাধানের চেষ্টা করা হয়।’
বাংলাদেশে একটি ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা বেশ খরচের ব্যাপার। অধ্যাপক আনোয়ারুল কবির অগ্রণী ব্যাংক থেকে শিক্ষকদের জন্য নির্ধারিত করপোরেট লোন নিয়ে নিজের বিভাগেই ল্যাবটি প্রতিষ্ঠা করেন। তবে কার্যক্রম শুরু করাটা এতটা সহজ ছিল না। ভবিষ্যতে ন্যানোটেকনোলজিই যে পৃথিবীকে শাসন করবে, এটা শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে ন্যানোটেকনোলজির প্রতি আগ্রহী করাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া ল্যাবে যে ব্র্যান্ডের রাসায়নিকগুলো ব্যবহার করা হয়, সেগুলো সঠিক উৎস থেকে সংগ্রহ করা, করোনার পর রিএজেন্টের (রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটাতে সাহায্য করে) দুষ্প্রাপ্যতা, ন্যানোপার্টিকেল তৈরির পর এর বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করার জন্য যথেষ্ট অবকাঠামো না থাকা—এসব সীমাবদ্ধতাও সামাল দিতে হচ্ছে।
ন্যানোপার্টিকেল তৈরির প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ল্যাবটিতে থাকলেও এর ব্যবহারিক দিক বা এটি মানুষের কী কাজে লাগে, সেটি দেখার কোনো সুযোগ-সুবিধা এখানে নেই। ল্যাবে তৈরি করা ন্যানোপার্টিকেল চিকিৎসাবিজ্ঞানে কোনো কাজে আসবে কি না, রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুকে ধ্বংস করার ক্ষেত্রে এর ক্ষমতা (অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ইফেক্ট) কেমন—সেসব বোঝা যায় ব্যাকটেরিয়ার ওপর ন্যানোপার্টিক্যালটি কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, তা দিয়ে। ফলে যেসব বিভাগের ল্যাবে ব্যাকটেরিয়া আছে (যেমন জেনেটিক প্রকৌশল বিভাগের মলিকিউলার বায়োলজি ল্যাব), তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে গবেষণার কাজ চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) সাহায্য নিয়েও ন্যানোপার্টিকেলের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণের কাজ করা হয়েছে অনেক দিন। এ ছাড়া দেশের বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের কপিন স্টেট ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরবের কিং সৌদ ইউনিভার্সিটি ও জাপানের কিউশু ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি—এই তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবের সঙ্গে তাদের সহযোগিতামূলক সম্পর্ক আছে।
ন্যানোটেকনোলজির বিশাল জগতের নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্র নিয়ে কাজ করা হয় ল্যাবটিতে। প্রতি বুধবার ল্যাবে একটি সভা হয়। কার কাজে কতটুকু উন্নতি বা অবনতি হলো, কারও কোনো সমস্যা আছে কি না, এসব নিয়ে আলোচনা হয় সভায়। ল্যাবে বর্তমানে ১৫ জনের একটি দল গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে।
২০২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এখানে কাজ করে দেশের বাইরে গেছেন মোট আটজন শিক্ষার্থী। তার মধ্যে চারজন পেয়েছেন ইরাসমাস মুন্ডাস স্কলারশিপ। সুপারিশপত্র থেকে শুরু করে গবেষণাপত্র প্রকাশ—সব বিষয়েই ল্যাবের সহযোগিতা পাওয়া যায়। তাই বৃত্তি পাওয়াটাও শিক্ষার্থীদের জন্য সহজ হয়। অধ্যাপক আনোয়ারুল কবির ভূঁইয়া এ প্রসঙ্গে বলছিলেন, ‘আমার এখানে যারা কাজ করতে আসে, তাদের আমি শুরুতেই পাসপোর্ট বানাতে বলি। কারণ, পাসপোর্ট থাকলে একজন শিক্ষার্থী দেশের বাইরে পড়াশোনার জন্য মানসিকভাবে এগিয়ে থাকে। পাশাপাশি আইইএলটিএস বা ইংরেজি দক্ষতার পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্যও এটা প্রয়োজন।’
ন্যানোপার্টিকেলকে নিউট্রিয়েন্ট বা ফার্টিলাইজার হিসেবে ব্যবহার করা যায় কি না, সে লক্ষ্য নিয়ে বর্তমানে ল্যাবটি কাজ করছে।