আমার মা একজন নিখাদ কৃষক

প্রতিবছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার বিশ্বজুড়ে পালিত হয় মা দিবস। সেই হিসাবে আগামীকাল মা দিবস। দিনটি উপলক্ষে মাকে নিয়ে পাঠকের কাছে লেখা আহ্বান করেছিল প্রথম আলোর শনিবারের ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’। নির্বাচিত একটি লেখা পড়ুন এখানে।

মায়ের সাহসই ইকরামুল হাসানের এগিয়ে চলার প্রেরণাছবি: সংগৃহীত

এভারেস্ট বেজক্যাম্পে আছি। প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে কয়েকটা দিন কেটে গেছে। শরীরে ১ হাজার ৪০০ কিলোমিটারের বেশি পথ হেঁটে আসার ধকল। এর মধ্যেই ঠিক হয়েছে ৬ মে রোটেশনে বের হব। একে একে ক্যাম্প থ্রি পর্যন্ত পৌঁছে আবার বেজক্যাম্পে নেমে আসব। এই পুরো রোটেশন এভারেস্ট অভিযানের মূল শৃঙ্গারোহণের প্রস্তুতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রচণ্ড ঠান্ডা, পাতলা বাতাস ও প্রতিকূল আবহাওয়ার সঙ্গে লড়াই করে শরীরকে মানিয়ে নেওয়ার এ ধাপই যে পরবর্তী অভিযানকে সফল করে তোলে। মাকে এসবের কিছুই বলি না, শুধু বলি—ওপরে গিয়ে আবার আসব, এ কয়েক দিন নেটওয়ার্ক থাকবে না। মা তখন মায়েদের মতো করে জানতে চান, কী খেলাম, শরীর কেমন আছে, হিমালয়ের মানুষগুলো কেমন?

আমার মা একজন নিখাদ কৃষক। শৈশব থেকেই জমিতে বাবার সঙ্গে মাকেও কাজ করতে দেখেছি। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা কখনই তাঁকে বসে থাকতে দেখিনি। বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের পুরো দায়িত্ব একা কাঁধে তুলে নিয়েছেন। জমি থেকে ঘর—সবকিছুই সামলেছেন।

মা যেমন মাটির গন্ধেই বোঝেন, কোন ফসল কেমন হবে, তেমনই বোঝেন আমার মনের ভাষা, আমার আবেগের জোয়ার-ভাটা।

‘সি টু সামিট’ অভিযানে মায়ের সঙ্গে দেখা
ছবি: সংগৃহীত

সি টু সামিট এভারেস্ট অভিযানের শুরুতেই মনে মনে ঠিক করেছিলাম, মাকে একবার চোখের দেখা না–দেখে যাব না। ২৫ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজার থেকে হাঁটা শুরু করে ১২ দিন পর ঢাকায় এলাম। সামনে দীর্ঘ, অনিশ্চিত এক পথ। একদিকে অজানার শিহরণ, অন্যদিকে বুকের ভেতর এক অদ্ভুত টান। কয়েক দিন ঢাকায় কাটিয়ে আবার এভারেস্টের উদ্দেশে হাঁটা শুরু করলাম। একসময় কালিয়াকৈরে যাত্রাবিরতি নিলাম। সোজা চলে গেলাম বাড়িতে, মায়ের কাছে।

মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। নিঃশব্দে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু চাপা দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা। আমি জানি, তিনি ভয় পাচ্ছেন। জানেন, এ অভিযানে প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে মৃত্যুর ছায়া লেগে আছে। কিন্তু মায়ের চোখে ভয় নেই, আছে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা।

মাথায় ও গায়ে হাত বুলিয়ে দিলেন মা, যার মধ্যে আশীর্বাদ, ভালোবাসা আর একসমুদ্র সাহস মিশে আছে। বললেন, ‘তুই পারবি। ভয় পাবি না...’

আমার চোখেও জল জমে আসে। বুকের ভেতর আবেগের স্রোত। এ বিদায় কঠিন, কিন্তু এ বিদায়ই তো আমার পথচলার শক্তি।

হাঁটতে থাকি সামনের দিকে। পেছনে তাকাই না। জানি, মা তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। তাঁর সেই চাহনিতেই লুকিয়ে আছে সমস্ত সাহস, ভালোবাসা আর আশীর্বাদ। এ এক বিদায়, যেখানে কষ্ট আছে, কিন্তু পরাজয় নেই; যেখানে চোখে জল আছে, কিন্তু দুর্বলতা নেই; যেখানে মায়ের ভালোবাসা আছে, তাই যত দুর্গমই হোক পথ, আমি থামব না…থামব না।

ইকরামুল হাসান: পর্বতারোহী

আরও পড়ুন