হার্ভার্ড গবেষকদের মতে স্ক্রিনমুক্ত এই ৮টি অভ্যাস শিশুর বুদ্ধি বাড়ায়

এক গবেষণায় দেখা গেছে, মার্কিন শিশুরা দিনে গড়ে ৫ ঘণ্টার বেশি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের গবেষণায় এই বদভ্যাসের কিছু নেতিবাচক দিক উঠে এসেছে। স্ক্রিনের দিকে দীর্ঘ সময় তাকিয়ে থাকা শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ, আচরণ ও শেখার ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাই শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক ও আবেগীয় বিকাশের সহায়তায় হার্ভার্ডের গবেষকেরা স্ক্রিনমুক্ত আটটি অভ্যাসের গুরুত্ব দিয়েছেন, যেসব শিশুদের মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতাকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াবে।

১. খাওয়ার সময় ফোন নয়

পরিবারের সবাই একসঙ্গে বসে খাওয়ার অভ্যাস করুন। খাওয়ার সময় কারও হাতে অকারণে ফোন রাখবেন না। একে অপরের সঙ্গে কথা বলুন। এতে শিশু আলোচনা এবং সামাজিক মেলামেশায় উৎসাহী হবে এবং তার ভাষাগত দক্ষতা এবং আবেগীয় সংযোগ গড়ে উঠবে।

পরিবারের সবাই একসঙ্গে বসে খাওয়া শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ
মডেল: বাবু, জুলফিকার, জাইন, রিনু, সিমি। ছবি : সুমন ইউসুফ

মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য এসব খুব গুরুত্বপূর্ণ। হার্ভার্ড টি ভি চ্যান স্কুল অব পাবলিক হেলথ ২০১৯ সালে ফ্যামিলি ডিনার প্রজেক্ট নামে একটি গবেষণা পরিচালনা করে। গবেষণাটিতে দেখা গেছে, পরিবারের সবাই নিয়মিত একসঙ্গে খেতে বসার সঙ্গে ভাষাগত দক্ষতা ও মানসিক স্থিরতার সম্পর্ক আছে।

২. বাইরে ঘুরতে বের হোন

বাইরে খেলাধুলা ও ঘোরাফেরা করলে শিশুর সংবেদনশীলতা ও সৃজনশীলতা বাড়ে। মোটর স্কিল এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। এসব উপকার স্ক্রিন দিয়ে কখনোই পাওয়া সম্ভব নয়।

প্রাকৃতিক পরিবেশে হাঁটা, পার্কে বেড়ানো ইত্যাদি শিশুর প্রতিদিনের কাজকর্ম গুছিয়ে করার ক্ষমতা বাড়ায়
মডেল: মৃন্ময়ী ও রাবু। ছবি: সুমন ইউসুফ

প্রাকৃতিক পরিবেশে হাঁটা, পার্কে বেড়ানো ইত্যাদি শিশুর প্রতিদিনের কাজকর্ম গুছিয়ে করার ক্ষমতা বাড়ায়। যেমন পরিকল্পনা, লক্ষ্য নির্ধারণ, সমস্যার সমাধান, নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়ানো ইত্যাদি।

হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের ২০২১ সালের গবেষণায় দেখা গেছে, ব্যায়াম করলে মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন বাড়ে। এটি নতুন স্নায়বিক সংযোগ তৈরিতে সহায়ক।

আরও পড়ুন

৩. বই পড়ুন, একে অপরকে গল্প শোনান

বই পড়লে শিশুর শব্দভান্ডার উন্নত হয়। এতে শিশুর মধ্যে নতুন নতুন ধারণা তৈরি হয়, শিশুর কল্পনাশক্তির বিকাশ ঘটে। হার্ভার্ডের গবেষকেরা একসঙ্গে বই পড়াকে উৎসাহিত করেন। এতে ভাষাগত দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। সাক্ষরতা এবং সমালোচনার সঙ্গে যুক্ত স্নায়বিক পথগুলো আরও শক্তিশালী হয়।

হার্ভার্ডের গবেষকেরা শিশুর সঙ্গে বই পড়াকে উৎসাহিত করেন
ছবি: কবির হোসেন

হার্ভার্ড সেন্টার অন দ্য ডেভেলপিং চাইল্ড ২০১৯ সালে একটি গবেষণা পরিচালনা করে। গবেষণাটিতে দেখা গেছে, একসঙ্গে বই পড়ার সময় মস্তিষ্কের বেশ কিছু অঞ্চল সক্রিয় থাকে। এসব অঞ্চল বোধগম্যতা ও সহমর্মিতাকে নিয়ন্ত্রণ করে।

৪. খেলাধুলা ও ব্যবহারিক কার্যক্রম

ব্লক ও পাজলের মতো খেলনা দিয়ে খেললে শিশুদের ফাইন মোটর স্কিল বৃদ্ধি পায়। এতে যুক্তির ব্যবহার এবং দ্রুত সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা বাড়ে। গবেষণায় দেখা গেছে, স্ক্রিনে কিছু দেখার চেয়ে বাস্তবে খেলাধুলা করলে শিশু আরও ভালোভাবে শিখতে পারে।

হার্ভার্ড গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব এডুকেশন ২০২০ সালে দ্য পাওয়ার অব প্লে নামে একটি গবেষণা পরিচালনা করে। গবেষণাটিতে বলা হয়, খেলাধুলা মানেই শিক্ষা থেকে বিরতি নয়, বরং এটি শিক্ষার ভিত্তি।

খেলাধুলার মধ্য দিয়ে শিশু পরিকল্পনা করতে শেখে
মডেল: ডা. নাইমুর রহমান ও পরিবার। ছবি: কবির হোসেন

হার্ভার্ডের গবেষকেরা দেখেছেন, খেলাধুলার মধ্য দিয়ে শিশু পরিকল্পনা করতে শেখে। মনোযোগ ও আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা বাড়ে। মস্তিষ্কের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সকে সক্রিয় করে।

শিশু যখন বাইরে খেলে, তখন সে নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে শেখে, সৃজনশীলভাবে সমস্যার সমাধান করতে পারে। কোনো অ্যাপ বা গেমস থেকে এসব উপকার পাওয়া যাবে না।

৫. সামাজিকতা এবং পারস্পরিক আলোচনাকে উৎসাহিত করুন

সরাসরি যোগাযোগ এবং পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া মানুষের সামাজিক দক্ষতা বাড়ায়। এতে সহমর্মিতা ও যোগাযোগের দক্ষতা বাড়ে। পরিচিত–অপরিচিত মানুষের সঙ্গে কথা বরলে শিশুর শব্দভান্ডার উন্নত হয়। শিশুরা সমাজে সহজে মিশতে পারে। অবসাদ ও বিষণ্নতার আশঙ্কা কেটে যায়। হার্ভার্ডের তথ্যমতে, প্রতিদিনের এই অভ্যাস শিশুর আবেগ নিয়ন্ত্রণ এবং মানসিক সুস্থতায় সহায়ক।

সরাসরি যোগাযোগ এবং পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া মানুষের সামাজিক দক্ষতা বাড়ায়
ছবি: তাফসিলুল আজিজ

২০২৪ সালের হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের গবেষণায় শিশুবিশেষজ্ঞরা বলেছেন, স্ক্রিন নিয়ে অতিরিক্ত ব্যস্ত থাকলে এসব উন্নতির সুযোগ কমে যায়। এতে আবেগ নিয়ন্ত্রণ ও সামাজিক বোধবুদ্ধির ওপরেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

৬. শোবার আগে স্ক্রিন ব্যবহারে লাগাম টানুন

স্ক্রিন থেকে নির্গত নীল আলো মেলাটোনিন নিঃসরণে বাধা দেয়। এতে ঘুম দেরিতে আসে। শোবার অন্তত এক ঘণ্টা আগে মুঠোফোন, টিভি, কম্পিউটার ইত্যাদি বন্ধ করে দিতে হবে। স্বাস্থ্যকর ঘুমের অভ্যাস স্মৃতিশক্তি বাড়ায়। এতে পড়াশোনায় মনোযোগ দেওয়া, পড়া দ্রুত শেখা সহজ হয়।

শোবার অন্তত এক ঘণ্টা আগে শিশুকে মুঠোফোন, টিভি, কম্পিউটার ইত্যাদি থেকে দূরে রাখুন
ছবি: সুমন ইউসুফ

শিশুরা সারা দিন যা কিছু শেখে, ঘুমের সময় মস্তিষ্ক সেই সব বিন্যস্ত করে। এভাবে শেখা পাকাপোক্ত হয়। হার্ভার্ডের গবেষকেরা দেখেছেন, ঘুম অনিয়মিত হলে মানুষের আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কমে যায়। বুদ্ধিবৃত্তিক কাজগুলোয় মানুষের দক্ষতা কমে।

আরও পড়ুন

৭. স্ক্রিনমুক্ত সময় বা দিন পালন করুন

নিয়মিতভাবে স্ক্রিনমুক্ত সময় বা স্ক্রিনমুক্ত দিন পালন করুন। এতে শিশুরা খেলাধুলা, আঁকাআঁকি, বই পড়ার মতো কাজে ব্যস্ত থাকবে। এতে তাদের বুদ্ধির বিকাশ দ্রুততর হবে। যেসব পরিবারে স্ক্রিনমুক্ত দিবস বা সময় পালন করা হয়, যেসব পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধন হয় দৃঢ়। পরিবারের সদস্যদের মন ভালো থাকে। তারা নিজেদের কাজেও মনোযোগী হয়।

নিয়মিতভাবে স্ক্রিনমুক্ত সময় বা স্ক্রিনমুক্ত দিন পালন করুন, এতে শিশুরা খেলাধুলা, আঁকাআঁকি, বই পড়ার মতো কাজে ব্যস্ত থাকবে
মডেল: নাসিম উদ্দিন আহমেদ, দিনা আলম, আদিয়ান ও জারা। ছবি: সুমন ইউসুফ

৮. স্ক্রিনের পরিমিত ব্যবহার

অভিভাবকদের উচিত সন্তানদের পরিমিতভাবে স্ক্রিন ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া। পরিবারের সবাই মিলে সময় কাটানোর সময় ফোন নামিয়ে রাখতে বলা যেতে পারে। এ ছাড়া সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারে পোস্ট করা ছবি বা লেখার সংখ্যার চেয়ে গুণগত মানকে প্রাধান্য দেওয়া প্রয়োজন।

শিশুদেরকে শিক্ষামূলক কনটেন্ট দেখতে উৎসাহ দিন। এ ছাড়া মেডিটেশন, মাইন্ডফুল ব্রিদিংয়ের মাধ্যমে আবেগ নিয়ন্ত্রণ এবং মনঃসংযোগ করতে শেখানো যায়। হার্ভার্ডের গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশু প্রতিদিন অন্তত ১০ মিনিট এসবের চর্চা করে, তারা অন্যদের চেয়ে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে এগিয়ে থাকে।

হার্ভার্ডের গবেষণা থেকে প্রমাণিত হয়, স্ক্রিনের প্রভাব সর্বব্যাপী হলেও এর নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য অপরিহার্য। স্ক্রিনটাইম সীমিত করার পাশাপাশি বাস্তব জগৎ সম্পর্কে শিশুকে ধারণা দেওয়ার মাধ্যমে শিশুর শিক্ষা ও সুস্থ জীবনের ভিত্তি মজবুত হয়।

সূত্র: হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল

আরও পড়ুন