‘স্যার, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় কেউ চেনে না’

১৯৯০–এর দশকের শুরুর দিকের কথা। তখন ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়’ ধারণাটাই আমাদের দেশে নতুন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও যে পড়ালেখা হতে পারে, অনেকেই জানত না। সেই সময়ে ঢাকার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজিতে (আইইউবিএটি) ভর্তি হন জাহিদুল হক। এখন তিনি ইস্টার্ন ব্যাংকের প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে কেমন ছিল তাঁর অভিজ্ঞতা? শুনুন তাঁর বয়ানে।

ইস্টার্ন ব্যাংকের প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা জাহিদুল হক ছিলেন আইইউবিএটির প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী
ছবি: জাহিদুল হকের সৌজন্যে

আইইউবিএটিতে ভর্তি হই ১৯৯২ সালে। সে সময় ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের’ ধারণা তো বটেই, বিবিএ প্রোগ্রামটিও আমাদের দেশে একেবারে নতুন। এখন যখন বিবিএর জনপ্রিয়তা দেখি, আইইউবিএটির সুনাম দেখি—বেশ ভালো লাগে। গর্বও হয়। মনে হয় একটা ইতিহাসের অংশ হয়ে আছি।

যেভাবে অংশ হলাম

বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা তখন সবে শুরু হয়েছে। আমার জানামতে, আইইউবিএটিই প্রথম। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি শুরু হয়েছিল তারও পরে, তবে অনুমোদন পেয়েছে আগে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির গ্রহণযোগ্যতা কেমন হবে, এখান থেকে পাস করে শিক্ষার্থীরা আদৌ চাকরি পাবে কি না, এমন নানা প্রশ্ন ছিল মানুষের মনে। কারোরই পরিষ্কার ধারণা ছিল না। না অভিভাবকের, না শিক্ষার্থীর। কিন্তু আইইউবিএটির প্রতিষ্ঠাতা আলিমউল্যা মিয়ান স্যারের সঙ্গে কথা বলে আমি আর আমার মা-বাবা খুব অনুপ্রাণিত হই। স্যার তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর শিক্ষক। তাঁর কাছেই জেনেছিলাম, বিবিএ একটি বাস্তবমুখী শিক্ষা, বিদেশে এর জনপ্রিয়তা আছে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন কারণে তখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে লম্বা সেশনজট হতো। বেসরকারিতে পড়লে সময় নষ্ট হবে না, দ্রুত চাকরির বাজারে পা রাখতে পারব, আমার সিদ্ধান্তের পেছনে এটাও একটা কারণ ছিল।

আরও পড়ুন

আমরা ১১ জন

ধানমন্ডি বাসস্ট্যান্ডের পেছনে একটা ভাড়া করা ভবনে ক্লাস হতো আমাদের। আমরা—মানে একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন বিভাগের ১১ জন মোটে শিক্ষার্থী। ক্লাস শেষ করেই আড্ডা দিতে চলে যেতাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি)। কারণ, বন্ধুবান্ধবের প্রায় সবাই তখন ঢাবিতে পড়ত। অনেক সময় খুব হীনম্মন্যতা কাজ করত। অনেকে একটু ছোট চোখেও দেখত।

তবে ছিল সুস্থ প্রতিযোগিতাও। আমাদের যাঁরা পড়াতেন, তাঁরা সবাই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। সকালে হয়তো ঢাবিতে ক্লাস করাতেন, বিকেলে আইইউবিএটিতে। এখনো আনিসুর রহমান, জগদীশ চন্দ্র শুক্লা দাস, শান্তিনারায়ণ ঘোষ, কামাল স্যারের কথা মনে পড়ে। আমরা সংখ্যায় অল্প ছিলাম বলে সবাই খুব যত্ন নিয়ে পড়াতেন। ব্যক্তিগত বিষয়, এমনকি গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে সমস্যার কথাও শিক্ষকেরা মন দিয়ে শুনতেন, কাউন্সেলিং করতেন। পড়াশোনা ও শিক্ষক নিয়ে এসব অভিজ্ঞতা ঢাবির বন্ধুদের শোনালে ওরা অবাক হতো। বলত, ‘তোরা টিচারদের সঙ্গে এসব আলাপ করিস! আমরা তো স্যারদের করিডর দিয়ে হেঁটে গেলেও ভয় পাই।’

কিন্ডারগার্টেনের বাচ্চাদের মতো হাতে ধরে পড়ানো হতো আমাদের। ক্লাস শেষে লাইব্রেরিতে বসে পড়াশোনার জন্য শিক্ষকেরা বাধ্য করতেন। এসব যে ভালো লাগত, তা নয়। বন্ধুরা অনেকে বলত, ‘তোরা তো বিশ্ববিদ্যালয়জীবনটা উপভোগই করতে পারিস না। তোদের ফার্মের মুরগি বানাচ্ছে।’ হয়তো এটাও সত্যি। কিন্তু দিন শেষে যা পেয়েছিলাম, সেটা আমাদের জন্য ভালোই হয়েছিল।

আইএউবিএটিতে তখন সারা বছরই কোনো না কোনো বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যাপকদের আনা হতো। উপাচার্য মিয়ান স্যার সারাক্ষণ এটা নিয়ে কাজ করতেন।

মিয়ান স্যারের একটা কথা আমার এখনো মনে আছে। তিনি বলতেন, ‘তোমরা যখন আমার কাছে পড়বে, তখন শিক্ষক হিসেবে আমাকে একদম পছন্দ হবে না। কিন্তু যখন পাস করে বের হয়ে যাবে, তখন আমাকে মিস করবে। পছন্দ করাও শুরু করবে।’ এখন আমি সত্যিই স্যারকে মিস করি।

আমি ছিলাম খুব অন্তর্মুখী স্বভাবের। সেটা কাটাতে মিয়ান স্যার আমাকে পাবলিক স্পিকিংয়ে যুক্ত করতেন। ভয় পেতাম, কিন্তু তবু তিনি দায়িত্ব দিতেন। জোর করে হোক, কিংবা প্রেরণা জুগিয়ে, যেকোনো উপায়ে আমাদের শিক্ষা দিতেন।

মাহমুদা খানম নামের একজন ম্যাডাম ছিলেন। মনোবিজ্ঞান পড়াতেন। মা, দাদি, নানি—সবার আদর তিনি একসঙ্গে দিয়েছেন। এমনকি একবার ব্যক্তিগত সমস্যা, অসুবিধার খবর নিয়ে বাসায় ফোন করে আমার মাকে বলেছিলেন, ‘ওর দিকে খেয়াল রাইখেন, আজকে ওর মন খারাপ দেখলাম।’

শুরুটা হয়েছিল ধানমন্ডির এক ভবনে। এখন উত্তরায় আইইউবিএটির বিশাল ক্যাম্পাস।
ছবি: বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌজন্যে

উন্নত শিক্ষা

আইইউবিএটি শুরু থেকেই পরিকল্পনা করে এগিয়েছে। আমাদের ব্যাচটা যেমন একটা ‘জয়েন্ট ডিগ্রি’ প্রোগ্রামের অধীন ছিল। চার বছরের শিক্ষাজীবনে দুই বছর আইইউবিএটির সঙ্গে, দুই বছর থাইল্যান্ডের নামকরা অ্যাজাম্পশন ইউনিভার্সিটির (তৎকালীন অ্যাবাক) সঙ্গে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এসে আমাদের ক্লাস নিতেন। কম্পিউটার ল্যাবের অত্যন্ত ধীরগতির ইন্টারনেট দিয়েও আমরা বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছি। জানতে পেরেছি, ব্যবসা প্রশাসন ডিগ্রিটা আসলে কীভাবে বাস্তবজীবনে বা চাকরির ক্ষেত্রে কাজে লাগতে পারে।

আইএউবিএটিতে তখন সারা বছরই কোনো না কোনো বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যাপকদের আনা হতো। উপাচার্য মিয়ান স্যার সারাক্ষণ এটা নিয়ে কাজ করতেন।

আরও পড়ুন

মিয়ান স্যারের স্মৃতি

মিয়ান স্যারকে নিয়ে আরেকটা ঘটনা মনে পড়ে। বিবিএর শেষ সেমিস্টারে ‘মার্কেটিং রিসার্চ’ নামে একটা কোর্স করছিলাম। স্যার নিজে এই কোর্স করাতেন। কোর্স শেষে থিসিস পেপার জমা দিতে হয়। আমি ও আমার বন্ধু বেশ খাটাখাটনি করে তথ্য সংগ্রহ করে সুন্দর রিপোর্ট তৈরি করলাম। বেলা দুইটায় ছিল জমা দেওয়ার শেষ সময়। টেবিল টেনিস খেলতে গিয়ে আমাদের ১৫ মিনিট দেরি হয়ে যায়। ভয়ে ভয়ে জমা দিতে যাই। রিপোর্ট ছুড়ে ফেলে দিয়ে স্যার বললেন, ‘তোমরা ১৫ মিনিট লেট।’

মাত্র ১৫ মিনিট দেরির জন্য শেষ সেমিস্টারে স্যার আমাদের দুজনকে ফেল করিয়ে দিলেন। আবার রিটেক নিতে হলো। অথচ মিডটার্ম ও ফাইনালে আমার নম্বর ছিল খুব ভালো।

পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের দুজন খুব ভালো ছাত্রকে আমি ফেল করে দিয়েছি। কারণ, ওরা দেরি করেছে। আমি জানি, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে ওরা বড় চাকরি করবে। তখন কোনো একটা কাজে টেন্ডারের কাগজ জমা দিতে দেরি হলে কিন্তু কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করবে না। এই শিক্ষাটা ওদের আমি দিতে চেয়েছি।’

আমার বয়স এখন ৫৩। বেশ কয়েকটা চাকরি করেছি। দায়িত্বপূর্ণ কাজ সামলেছি, বহু দেশে গিয়েছি। ধরতে হয়েছে বাস, ট্রেন ও প্লেন। কিন্তু এই শিক্ষা আমার সব সময় মনে থাকে। আমি আর কোনো দিন কোনো কাজে দেরি করিনি। প্রয়োজনে এক ঘণ্টা আগে পৌঁছেছি, তবু দেরি করিনি।

আইইউবিএটির প্রতিষ্ঠাতা আলিমউল্যা মিয়ান নানাভাবেই প্রভাব রেখেছেন জাহিদুল হকের জীবনে

অস্তিত্ব তৈরিই বড় চ্যালেঞ্জ

সে সময় নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয় দেওয়াই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। কেউ চিনত না। আত্মীয়স্বজনকে নানাভাবে বোঝাতে হতো। একে তো বেসরকারি, তার ওপর ধানমন্ডির বাসস্ট্যান্ডের পেছনে ক্যাম্পাস। ভর্তি করার জন্য শিক্ষার্থী খুঁজে পাওয়া যেত না। কারণ, ভাবা হতো খারাপ ছাত্ররাই বেসরকারিতে ভর্তি হয়।

একবার খুব হতাশা নিয়ে আমরা মিয়ান স্যারের কাছে গেলাম। বললাম, ‘স্যার, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় কেউ চেনে না। আইইউবিএটি বললে মানুষ হাসাহাসি করে। বলে, এর মানে আই ইউ ব্যাট-আমি তুমি ব্যাটিং করি। কোথাও কোনো সাইনবোর্ডও নাই।’ স্যার বললেন, ‘কী করতে চাও?’

আমাদের একজন বলল, ‘স্যার, ঢাকাতে যেসব বাস চলে, সেগুলোতে আইইউবিএটির স্টিকার লাগিয়ে দিই। তাহলে শহরের মানুষ চিনবে।’ তিনি বললেন, ‘বিজ্ঞাপন মানুষ মনে রাখে না। মনে রাখে খবর। যদি স্নাতক পাস করে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারো, তখন যেভাবে চিনবে, সেটা হবে খবর। সেই চেষ্টা করো।’

এখন বুঝি, স্যার ঠিক বলেছিলেন। আইইউবিএটির ছাত্ররা একসময় বিদেশে এমবিএ করতে গেলেন, এই খবরগুলো জেনেই মানুষের ধারণা বদলেছে।

একসময় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ইন্টারভিউতে ডাকা হলেও চাকরি খুব একটা হতো না। এখন পরিস্থিতি বদলেছে। বাংলাদেশের প্রতিটা ক্ষেত্রে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকেরা ভালো করছেন। এসব দেখে একধরনের সুখ অনুভূত হয়। কারণ, আজকের দিনে পৌঁছাতে যে দীর্ঘ লড়াই করতে হয়েছে, তার পেছনে আমিও কিছুটা ভূমিকা রাখতে পেরেছি।

আরও পড়ুন