শিল্পবর্জ্যের ভাগাড়কে রূপ দিলেন পার্কে, তাতেই পেলেন আর্কেশিয়া পুরস্কার
১০ সেপ্টেম্বর, দক্ষিণ কোরিয়া। ইনচিয়ন শহরের ওরাকাই সংডো পার্ক হোটেলের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেই চোখে পড়ে সেন্ট্রাল পার্ক। ওই পার্কে সন্ধ্যা নামে ঝুপ করে। তেমনই ঝুপ করে নামা এক সন্ধ্যায় স্থাপত্যে এশিয়ার অন্যতম সেরা স্বীকৃতি আর্কেশিয়া পুরস্কার পেলেন এ বছরের বিজয়ীরা। ‘সোশ্যাল রেসপন্সিবল আর্কিটেকচার’ বিভাগে বিশেষ স্বীকৃতি পেলেন ‘স্থাপতিক’–এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান স্থপতি শরীফ উদ্দিন আহম্মেদ।
যে প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশে এল পুরস্কারটি
রাজধানীর জাহাঙ্গীর গেট থেকে মহাখালী যাওয়ার পথে রাস্তার বাঁ পাশে এসকেএস টাওয়ার। তার ঠিক পেছনে ছিল ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানির একটা কারখানা। যে জায়গায় কারখানাটি ছিল, সেটি মূলত সেনাবাহিনীর, মহাখালী ডিওএইচএস (ডিফেন্স অফিসার্স হাউজিং স্কিম)–এর।
১৯৬০ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাছ থেকে জায়গাটি ইজারা নিয়েছিল এই প্রতিষ্ঠান। কারখানার দক্ষিণ দিকের এই জায়গায় বহু বছরের আবর্জনা জমে বনজঙ্গলের মধ্যে এক ভাগাড়ে পরিণত হয়েছিল। এ ছাড়া বর্ষাকালে এই জায়গায় এক থেকে দেড় ফুট পর্যন্ত পানি জমত। সেই জলাবদ্ধ পানি কৃত্রিম আন্ডারগ্রাউন্ড ট্যাংকে জমা করা হতো এবং সেই ট্যাংক থেকে পাম্পিংয়ের মাধ্যমে বাইরে ফেলে দেওয়া হতো। এর পেছনে প্রতিষ্ঠানটির বছরে খরচ হতো কয়েক কোটি টাকা।
স্থপতি শরীফ উদ্দিন আহম্মেদ এই জায়গাটিকে প্রথমে একটা রাস্তা, চেকপোস্ট, বাগান, জগিং স্পেস, মিটিং প্লেস মিলিয়ে প্রায় ৭-৮ কোটি টাকার একটা প্রকল্পের পরিকল্পনা জমা দেন। সেটি বাতিল হয়ে যায়। এরপর জায়গাটির বর্জ্যকেই কাজে লাগিয়ে মাত্র ১ কোটি ৭২ লাখ টাকায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেন। আর সেই প্রকল্পই বাংলাদেশকে এনে দিয়েছে এই সম্মানজনক পুরস্কার।
আমরা এমন একটা পরিবেশবান্ধব প্রাকৃতিক স্পেস তৈরি করতে চেয়েছি, যেখানে বিভিন্ন প্রাণী, পাখি, গাছ, ফুল, প্রজাপতি, মানুষ সবাই মিলেমিশে থাকবে।শরীফ উদ্দিন আহম্মেদ, প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান স্থপতি, স্থাপতিক
প্রকল্পের ভাবনা
প্রকল্পটির শুরুতে ক্লায়েন্ট ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশের চাহিদা ছিল মূলত একটি যানবাহন চলাচলের রাস্তা। সঙ্গে চেকপোস্ট, ট্রাক পার্কিং এবং হাঁটার পথ তৈরি করা। কিন্তু স্থপতি শরীফ উদ্দিন আহম্মেদের মনে ছিল বৃহত্তর সামাজিক দায়িত্বের ভাবনা।
‘স্থাপতিক’ চেয়েছিল, এই প্রকল্প জীববৈচিত্র্যের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করবে। পাশাপাশি নিরসনের চেষ্টা করবে স্থানটির জলাবদ্ধতা। আর মানুষের জন্য নির্মল শ্বাস নেওয়ার উন্মুক্ত ক্ষেত্র তৈরির বিষয়টিও মাথায় ছিল তাদের।
এখানে শ্রমিক ও অফিসকর্মীদের শ্রেণিবিভাজন ভাঙার কথা ভেবেছিলেন শরীফ উদ্দিন আহম্মেদ। সবাই যেন জীবনের উচ্ছ্বাস ভাগ করে নিতে পারেন, এমন এক ক্ষেত্র সৃষ্টি করাই ছিল মূল লক্ষ্য। পাশাপাশি জায়গাটির বর্জ্য পুনর্ব্যবহারের ফলে নির্মাণ ব্যয়ও হয়েছে ন্যূনতম।
কীভাবে কী হলো
প্রায় ৩ একরজুড়ে থাকা এই ভাগাড় ক্লায়েন্টের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি স্থপতি সেখানে নির্মাণ করেন একটি প্রাকৃতিক জলাধার।
ক্লায়েন্টকে স্থপতি শরীফ বোঝান, বর্ষাকালে জমে থাকা পানি এই জলাধারে প্রাকৃতিকভাবেই সংরক্ষিত হবে। সমাধান হবে জলাবদ্ধতার। আশপাশের জলজ ও স্থলজ প্রাণী ও গাছপালার জন্যও ভালো হবে।
জলাধার তৈরির ফলে স্থানটি একদিকে যেমন শীতল, স্নিগ্ধ, আরামদায়ক ও প্রশান্তিময় হয়েছে, তেমনি বানর, বাদুড় ও বেজিসহ নানা প্রাণীর খাবার ও পানির ব্যবস্থা হয়েছে।
পরিবেশগত সমস্যার প্রাকৃতিক সমাধান
এই এলাকায় ছিল উঁচু উঁচু মেহগনিগাছ। বর্ষার সময় জমে থাকা পানিতে মেহগনির পাতা ও ফল পড়ে পুরো জায়গাটি বিষাক্ত হয়ে যেত। স্থপতি শরীফ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ‘মেহগনির ফল আসলে বিষাক্ত (এটা দিয়ে কীটনাশক তৈরি হয়)। এর কারণে বড় মেহগনি গাছের নিচে ঝোপঝাড় কিংবা ছোট গাছ বেড়ে উঠতে পারে না। তবে আমরা ঠিক করলাম, কীভাবে একটি মেহগনিগাছ না কেটেও এই পরিবেশগত সমস্যার প্রাকৃতিক সমাধান করা যায়। শেষমেশ আমরা কোনো গাছই কাটিনি। বরং নতুন ধরনের বেশ কিছু গাছ লাগিয়েছি। গাছের ভেতর দিয়েই এমনভাবে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে, যাতে একটি গাছও ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।’
পানির সমস্যা যেভাবে সামলালেন
জমে থাকা পানির সমস্যার সমাধানের জন্য এখানে এমন সব গাছ লাগানো হয়েছে, যেসব দ্রুত পানি শোষণ করে এবং সেই সঙ্গে পানিকে পরিশোধন করে ভূগর্ভস্থ প্রাকৃতিক জলাধারে পৌঁছে দেয়।
ফলে এখন এই জলাধারে স্থায়ীভাবে পানি জমে থাকে না। বর্ষার সময় বৃষ্টির পানি জমলেও তা তিন-চার ঘণ্টার মধ্যেই সরে যায়। এই ব্যবস্থাপনা পুরো ঢাকা শহরের জমে থাকা পানির একটি কার্যকর সমাধানের উদাহরণ হিসেবে কাজ করতে পারে বলে দাবি করলেন শরীফ উদ্দিন আহম্মেদ।
নির্মাণ ব্যয় যেভাবে কমল
পার্কটিতে লাগানো হয়েছে নানা দেশীয় গাছ। গড়ে তোলা হয়েছে ফুলের বাগান। ক্লায়েন্টের প্রধান চাহিদা অনুযায়ী, বিদ্যমান বর্জ্য উপকরণ ব্যবহার করে একটি রাস্তা ও চেকপোস্ট তৈরি করা হয়েছে। অর্ধশত বছরে যত ধাতব এবং স্লাব ও ইটের টুকরার মতো বর্জ্য জমেছিল, সেসব রিসাইকেল বা পুনর্ব্যবহার করে এই রাস্তার পিচ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে রাস্তা তৈরির বিশাল খরচ কমে গেছে অনেকটাই।
এই পার্কে এখন প্রতিষ্ঠানের কর্মী থেকে সাধারণ মানুষ সবাই হাঁটাহাঁটি বা বসে গল্প করতে পারছেন। প্রকল্পটি সম্পন্ন করার কয়েক মাসের মধ্যেই কয়েকটি মৌমাছির চাকও দেখা গেছে। নানা ধরনের পাখির কলতানে মুখর তো থাকছেই।
তার মানে জলজ পরিবেশ, পাখি, ফুল, বিভিন্ন প্রাজাতির গাছ, প্রাণী মিলে যে বাস্তুতন্ত্র তৈরি হয়েছে, তা মৌমাছি বাসা বানানোর জন্য উপযোগী। বিষাক্ত যে পরিবেশে ময়লা–আবর্জনা ফেলা হতো, সেখানেই আজ ফুটছে ফুল। পাখিরা বাসা বাঁধছে নতুন নতুন গাছে।
শরীফ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ‘আমরা এমন একটা পরিবেশবান্ধব প্রাকৃতিক স্পেস তৈরি করতে চেয়েছি, যেখানে বিভিন্ন প্রাণী, পাখি, গাছ, ফুল, প্রজাপতি, মানুষ সবাই মিলেমিশে থাকবে।’
২০২২ সালে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয় এবং শেষ হয় ২০২৩ সালের শুরুতে। প্রকল্পটি গত তিন বছর সফলভাবে পরিচালিত হয়েছে এবং একটি কার্যকর ‘ল্যান্ডস্কেপিং’ সমাধান হিসেবে প্রমাণিত। তবে এ বছরের জুলাই মাস থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জায়গাটি আইনগতভাবে ফেরত নিয়েছে।
এই প্রকল্পের এখন কী হবে
স্থপতি শরীফ উদ্দিন আহম্মেদ জানান, প্রকল্পটি এভাবে রেখেই ব্যবহার করতে চাইলে সেটির সঙ্গে সমন্বয় করা যাবে। তিনি বলেন, ‘বিশ্বে এ রকম অনেক স্থাপনা আছে। একটা পরিত্যক্ত কারখানাকে হয়তো জাদুঘর বা কনসার্টের হলরুম বানিয়ে ফেলা হয়েছে। পাবলিক স্পেস বা আরও নানাভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। সেনাবাহিনী যে কাজেই জায়গাটি ব্যবহার করুক না কেন, এই প্রকল্প আত্তীকরণ করেই মাস্টারপ্ল্যান করা সম্ভব।’
মজার বিষয় হলো, ২০২৫ সালের শুরুতে যখন ‘স্থাপতিক’ এই প্রকল্প আর্কেশিয়ার জন্য জমা দেয়, তখন ‘সোশ্যাল রেসপন্সিবল আর্কিটেকচার’ নামে কোনো ক্যাটাগরিই ছিল না।
এ ছাড়া যে ১২টি ক্যাটাগরি ছিল, তার কোনোটিতেই প্রকল্পটি পুরোপুরি জুতসই হচ্ছিল না। তাই আর্কেশিয়া জুরিবোর্ড ৩০০টির বেশি জমা প্রকল্পের মধ্যে এই প্রকল্পকে বিশেষভাবে সম্মানিত করেছে ‘সোশ্যাল রেসপন্সিবল আর্কিটেকচার’ ক্যাটাগরিতে।
গত বছর মানিকগঞ্জের শববাড়ি-হিজুলী এলাকায় গড়ে তোলা ‘শাহ মোহাম্মদ মহসীন খান দরগাহ’ নকশার জন্য শরীফ উদ্দিন আহম্মেদ পান স্থাপত্যে মর্যাদাপূর্ণ রিবা (রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ব্রিটিশ আর্কিটেক্টস) পুরস্কার।