গণহত্যার সত্য উন্মোচনে ফরেনসিক বিজ্ঞানের প্রয়োগ নিয়ে গবেষণা করছেন নিগার

মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত গণহত্যা বিশ্লেষণে ফরেনসিক বিজ্ঞানের প্রয়োগ নিয়ে গবেষণা করছেন তাবাসসুম নিগার। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব জেনোসাইড অ্যান্ড জাস্টিসের তরুণ এই গবেষকের কাজ সম্পর্কে জেনে অনুলিখন করেছেন সজীব মিয়া 

তরুণ গবেষক তাবাসসুম নিগারছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

স্নাতকে আমার থিসিসের বিষয় ছিল ‘রোহিঙ্গা গণহত্যা’। ২০২২ সালে এ কাজের জন্য যখন জেনোসাইড বা গণহত্যা নিয়ে পড়াশোনা করছিলাম, তখন বারবার মনে হচ্ছিল আমরা নিজেরাও তো ভুক্তভোগী জাতি। অথচ মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত গণহত্যা নিয়ে দেশে একাডেমিক কাজ এখনো অনেক সীমিত। আন্তর্জাতিকভাবেও আমরা এই গণহত্যার স্বীকৃতি পাইনি। 

তখন জানার চেষ্টা করলাম দেশে কীভাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন চর্চা হচ্ছে, কোন প্রতিষ্ঠানগুলো এ বিষয়ে গবেষণা করছে। সেই খোঁজ করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের রিসার্চ সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব জেনোসাইড অ্যান্ড জাস্টিসের সন্ধান পাই। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে স্নাতক করে তিন বছর আগে এই সেন্টারে যুক্ত হই। এরপর বিভিন্ন দেশের গণহত্যা নিয়ে গবেষণা করছি। 

শুরুতে বাংলাদেশ ও কম্বোডিয়ার গণহত্যা নিয়ে কাজ করেছি। এখন গবেষণার পরিসর আরও বিস্তৃত হয়েছে। আমি রুয়ান্ডা ও বাংলাদেশের গণহত্যার একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ করছি। পাশাপাশি বাংলাদেশের গণহত্যায় ফরেনসিক অ্যানথ্রোপলজি (নৃবিজ্ঞান) ও ফরেনসিক আর্কিওলজি (প্রত্নতত্ত্ব) কীভাবে প্রয়োগ করা যায়, তা নিয়ে গবেষণা করছি। এগুলো ফরেনসিক বিজ্ঞানের বিষয়। ফরেনসিক বিজ্ঞান গণহত্যার সত্য উন্মোচনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এর মাধ্যমে হত্যার স্থান শনাক্তকরণ, ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া দেহাবশেষ সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হয়। 

বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে ফরেনসিক বিজ্ঞানের কাজ খুবই সীমিত। স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছর পার করে এসে আমরা কি এখনো এ বিষয়ে কাজ করতে পারি? কীভাবে করতে পারি? এটাই আমার বর্তমান গবেষণার বিষয়। 

আমার গবেষণার কাজে বিভিন্ন দেশে প্রশিক্ষণের সুযোগ পাচ্ছি। সম্প্রতি রুয়ান্ডা ঘুরে এসেছি। ১৯৯৪ সালের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত ১০০ দিনের মধ্যে প্রাণ হারিয়েছিল রুয়ান্ডার প্রায় আট লাখ নাগরিক। এই গণহত্যা নিয়ে দেশটিতে অনেক কাজ হয়েছে। আমি গিয়েছিলাম গুয়াতেমালার গ্লোবাল ফরেনসিক একাডেমির কর্মশালায় নির্বাচিত হয়ে। এতে ১৫টি দেশ থেকে ২৯ জন গবেষক অংশ নেন। কর্মশালাটি ছিল সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক-ফরেনসিক আর্কিওলজি, ফরেনসিক অ্যানথ্রোপলজি, গণহত্যাস্থলে খনন, চিহ্নিতকরণ। এসব প্রক্রিয়া আমি সেখানে হাতে-কলমে শিখেছি। 

রুয়ান্ডা সফরে আমাকে সবচেয়ে যে বিষয়টি স্পর্শ করেছে, তা হচ্ছে গণহত্যার সুশৃঙ্খল ডকুমেন্টেশন। তাদের স্মৃতিস্তম্ভ, জাদুঘর, বধ্যভূমি অত্যন্ত যত্নে সংরক্ষিত। ছোটবেলা থেকেই রুয়ান্ডার মানুষেরা এসব জায়গা পরিদর্শন করে এবং নিজেদের ইতিহাস সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পায়। 

তাবাসসুম নিগার পরিবার থেকেই অনুপ্রেরণা পেয়েছেন সমাজ-মানবতার বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

একাত্তর অতীতের অধ্যায় নয় 

আমার জন্ম মুক্তিযুদ্ধের প্রায় ৩০ বছর পর। তবে গণহত্যা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে বুঝেছি একাত্তর অতীত অধ্যায় নয়, আমাদের ভেতরে বয়ে চলা বাস্তবতা। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের বিশাল আর্কাইভ, প্রত্যক্ষদর্শীদের স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা, প্রতিবেদন আর গবেষণাপত্র ব্যবহার করে আমি নিজের মতো করেই ইতিহাস আর আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন নতুন করে পড়ছি। নিজেকে প্রশ্ন করছি, নিজের অবস্থান যাচাই করছি। 

গণহত্যাবিরোধী ‘নেভার এগেইন’ বা ‘আর কখনো নয়’ স্লোগানটি শুধু মানবতার প্রতি প্রতিশ্রুতি নয়, গণহত্যা নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন, তাঁদের নৈতিক ভিত্তিও। আমাদের মতো ভুক্তভোগী জাতির জন্য তো আরও বেশি, কারণ আমরা এখনো ১৯৭১ সালের গণহত্যার নির্মম অভিজ্ঞতা বুকে চেপে ন্যায়বিচার, স্বীকৃতি ও ক্ষতিপূরণের জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছি। 

আমি জেন-জি প্রজন্মের একজন, যারা ইতিহাসকে নতুন দৃষ্টিতে জানতে চায়। পরিবার থেকেই অনুপ্রেরণা পেয়েছি সমাজ-মানবতার বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে। ভবিষ্যতে গণহত্যার এই ক্ষেত্রটি নিয়েই কাজ করে যেতে চাই। 

আরও পড়ুন