অন্যের কথা শুনে সিদ্ধান্ত বদল করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়: কৈলাস সত্যার্থী

২০১৪ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান ভারতের সমাজকর্মী কৈলাস সত্যার্থী। এই তড়িৎ প্রকৌশলী ১৯৮৩ সালে গড়ে তোলেন ‘বাচপন বাঁচাও আন্দোলন’। অলাভজনক এই সংস্থা ভারতে শিশু পাচার ও শিশুশ্রম বন্ধে কাজ করছে। ‘ডিফেন্ডারস অব ডেমোক্রেসি’, ‘মেডেল অব দ্য ইতালিয়ান সেনেট’, ‘রবার্ট এফ কেনেডি ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস অ্যাওয়ার্ড’-এর মতো একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের প্রথম সমাবর্তনে বক্তা হয়ে এসেছিলেন সম্প্রতি। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) অধ্যাপক রিদওয়ানুল হক ও প্রথম আলোর প্রতিবেদক মোছাব্বের হোসেন

কৈলাস সত্যার্থী
ছবি: মোছাব্বের হোসেন

নানা দেশের পুরস্কার পেয়েছেন। পুরস্কারকে কীভাবে দেখেন?

আমার কাছে মনে হয়, সৃষ্টিকর্তার দেওয়া সবচেয়ে বড় পুরস্কার হলো ‘চোখ’। কারণ, চোখ দিয়েই আমরা সুন্দর ও আলাদা কিছু দেখতে পাই। এই চোখ আপনার জেদকে উসকে দেয়, ভালো কিছু করার তাগিদ দেয়।

আরও পড়ুন

তরুণদের অনেকেরই ভালো কিছু করার ইচ্ছা আছে। তাঁদের কী পরামর্শ দেবেন?

তরুণদের এগিয়ে যাওয়ার জন্য তিনটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো হলো থ্রিডি: ড্রিম, ডিসকভার আর ডু। স্বপ্ন দেখুন, নিজেকে আবিষ্কার করুন আর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করুন। ভালো কোনো কিছুর জন্য প্রথমে যোগাযোগের দক্ষতা খুব জরুরি। বদল, অগ্রগতি ও উন্নতি—এই তিনের প্রধান প্রভাবক হলো যোগাযোগের দক্ষতা। এই দক্ষতার উন্নয়ন খুব জরুরি। চারদিকে অনেক ইতিবাচক ও নেতিবাচক বিষয় আছে। সবকিছু গ্রহণের দরকার নেই। ইতিবাচক দিক নির্বাচন করে তা থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে গেলে কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়।

আপনার এগিয়ে যাওয়ার মন্ত্র কী?

আপনি যা করতে চাচ্ছেন, অনেকের তা পছন্দ না-ও হতে পারে। অনেকে বলতে পারেন, এটা সম্ভব নয়, কেন এটা করবেন? কিন্তু অন্যের কথা শুনে নিজের সিদ্ধান্ত বদল করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আমার কাজও অনেকের কাছে মনে হতো কিছুই না। গায়ে পড়ে অনেকে বলত, তুমি শিশুদের নিয়ে কাজ করো কেন? কী লাভ! কিন্তু আমি আমার লক্ষ্য ঠিক রেখেছিলাম। নিজের কাজটা মনোযোগ দিয়ে করে গেছি। আমার কাছে মন্ত্র এটাই—লক্ষ্য ঠিক করে এগিয়ে যাওয়া।

কৈলাস সত্যার্থী
ছবি: মোছাব্বের হোসেন

শিশুদের শিক্ষার অধিকার নিয়ে আপনি কাজ করেন। শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের কী করা উচিত বলে আপনি মনে করেন?

শিক্ষা একটি আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি। এটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব শুধু দেশের নয়, সারা বিশ্বের ধনী দেশগুলোরও। এটা নিশ্চিত করা, পুরুষদের পাশাপাশি নারীশিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া। এ জন্য পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। না হলে সামগ্রিক সফলতা আসবে না। নারীদের পক্ষে সবাইকে কথা বলতে হবে। নারীশিক্ষা, বাল্যবিয়ে ও শিশুদের অধিকার রক্ষা হলেই দেশ এগিয়ে যাবে। শিক্ষা সমতায় দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ এগিয়ে। শুধু সরকারের একার পক্ষে এটা করা সম্ভব ছিল না। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলের পেছনে অনেকের অবদান রয়েছে। শিক্ষায় বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে। আরও এগোবে বলে মনে করি।

বাংলাদেশে কি এটাই আপনার প্রথম আসা?

১৯৮৬ সাল থেকে বহুবার বাংলাদেশে এসেছি। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়েছি। এখানে যাঁরা শিক্ষা নিয়ে কাজ করেন, তাঁদের সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ আছে। আজও রাশেদা কে চৌধূরীর সঙ্গে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। তিনিও শিক্ষা নিয়ে কাজ করেন।

তরুণ উদ্যোক্তাদের প্রতি পরামর্শ কী?

তরুণ উদ্যোক্তাদের বলব, এটা কোনো ফ্যাশন নয়। একটি ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করতে হবে। যা করবেন, দায়িত্ব নিয়ে করবেন। দায়সারা কোনো কাজ সফল হয় না। আর ভালো কাজ করতে আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। এই আত্মবিশ্বাসই আপনাকে এগিয়ে নেবে। আপনাকে অবশ্যই মানবিক হতে হবে। মানবিকতা কেউ শিখিয়ে দিয়ে যাবে না। কোনো ধর্মীয় নেতা এসেও এটা শেখাতে পারবেন না। নিজেই নিজেকে মানবিকতা শেখাবেন। ভালো মানুষ হতে চর্চা করে যেতে হবে।

কী আপনাকে অনুপ্রাণিত করে?

শিশুদের জন্য কাজ করাই আমার অনুপ্রেরণার মূল উৎস। অনেক বছর আগে যখন শুরু করি, তখন শিশু অধিকার নিয়ে কথা বলার মতো অবস্থা ছিল না। শিশু অধিকারের কথা বললে মানুষ এড়িয়ে যেত। শিশুশ্রম যে একটা অপরাধ, সেটা মানুষ মানতেই চাইত না। শিশুশ্রমকে তাঁরা স্বাভাবিক বলে ধরে নিত। আমার কাজকে অবহেলা করত। আমি মনে করি, সামাজিক পরিবর্তন আসে অবজ্ঞা থেকে। গান্ধী বলেছিলেন, ‘মানুষ প্রথমে তোমাকে অবজ্ঞা করবে, তোমাকে নিয়ে হাসবে, তোমার সঙ্গে লড়াই করবে, আর তারপর তুমি জয়ী হবে।’

সময় দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

আপনাদেরও ধন্যবাদ।