শাবানার মোড় যেভাবে বকুলতলা হয়ে উঠল
কেউ বলতেন বিহারিপাড়া, কেউ সাহেবপাড়া, অনেকে আবার জায়গাটাকে শাবানার মোড় নামে চিনতেন। দিনাজপুরের বিরামপুর পৌর শহরের এ জায়গাটা এখন ‘বকুলতলা মোড়’। নামের মতো একসময়কার সাদামাটা এই মোড়ের সৌন্দর্যেও এসেছে পরিবর্তন। কীভাবে এল এই পরিবর্তন? দেখে এসে জানাচ্ছেন নূরে আলম সিদ্দিকী
দূর থেকে মনে হলো কোনো অভিজাত এলাকার রাস্তায় ঢুকে পড়েছি। দুই পাশে রকমারি ফুলগাছ। শোভা পাচ্ছে পাঁচ রঙের জবা, চেরি, হাসনাহেনা, তিন ধরনের চায়না টগর, আছে দেশি টগর, বাগানবিলাস, জারুল, সোনালু, সন্ধ্যামালতী, দেয়ালে ওয়াল ক্রিপার। কামিনীগাছের ডালপালাকে সুন্দর করে ছেঁটে সোফার মতো করা হয়েছে। মাথার ওপরে আমগাছে শোভা ছড়াচ্ছে হলুদ অলকানন্দা। পাশেই ছোট–বড় তিনটি বকুলগাছ।
বিরামপুর শহরের পূর্ব জগন্নাথপুর এলাকার বকুলতলা মোড়টি আসলে তিন রাস্তার মিলনস্থল। মোড়ের পূর্ব দিকে প্রায় ৩০০ ফুট, দক্ষিণে প্রায় ২৫০ ফুট আর পশ্চিমে প্রায় ১০০ ফুট রাস্তার দুই পাশে এই পুষ্পবীথি গড়ে তোলা হয়েছে। মোড়ে সবার বসার ব্যবস্থা আছে। আছে মহল্লার প্রবীণ ও অবসরপ্রাপ্তদের জন্য ‘প্রবীণ আসর’। সেখানে সবার পড়ার জন্য রাখা হয় দু-তিনটি জাতীয় দৈনিক। রাস্তাসংলগ্ন দেয়ালে শোভা পাচ্ছে বড় ডিজিটাল ঘড়ি। একটি বিদ্যুতের খুঁটিতে লাগানো আছে মহল্লার স্থান নির্দেশক ম্যাপ। পূর্ব পাশের রাস্তায় খুঁটির সঙ্গে সাঁটানো ট্রেন সময়সূচির বোর্ড। সকালে রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করা সাধারণ মানুষদের জন্য ওজন মাপার যন্ত্র আর উচ্চতা মাপার স্কেল। আর এ সবকিছুই ব্যবহার করা যায় বিনা মূল্যে।
সুন্দর বকুলতলা মোড়ের কারিগর স্থানীয় বাসিন্দা নূরে আলম সিদ্দিক। পেশায় তিনি বিরামপুর পৌরসভার তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী।
শাবানার মোড়
শুরুটা ২০১১ সালের মাঝামাঝি। মোড়ে শাবানা নামের এক নারীর একটি দোকান ছিল। অনেকে তাই মোড়টিকে ‘শাবানার মোড়’ নামে চিনতেন। বকুলতলা মোড়ের স্থানীয় বাসিন্দা মনির উদ্দিন মাস্টার একদিন নূরে আলম সিদ্দিককে বললেন, ‘তোমার বাড়ির সামনের বকুলগাছটিকে কেন্দ্র করে এলাকার একটা সুন্দর নাম রাখো।’ স্থানীয় গুণীজন ও জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক করে মোড়টার নাম রাখা হলো বকুলতলা। ২০১২ সালের ১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় শহরের রিকশা ও ভ্যানচালক, স্থানীয় সুধীজন, তৎকালীন পৌর মেয়র আজাদুল ইসলাম ও স্থানীয় পৌর কাউন্সিলরের উপস্থিতিতে বকুলতলা মোড় উদ্বোধন করা হয়।
এরপরই নিজের ভালো লাগা থেকে স্বেচ্ছায় মোড়ের সৌন্দর্য বাড়ানোর কাজ করে যাচ্ছেন সিদ্দিক। শুরুর দিকে স্থানীয় অনেকেই বাড়ির সামনের রাস্তায় শোভাবর্ধক ফুলগাছ লাগানোতে বাধা দিলেও পরে তাঁদের ভুল ভাঙে। এখন আশপাশের বাড়ির মালিকেরা নিজ উদ্যোগেই ফুলগাছ লাগাচ্ছেন। বকুলতলা মোড়কে সুন্দর করতে ব্যক্তিগত উদ্যোগে এক দশকে প্রায় ছয় লাখ টাকার মতো খরচ করেছেন বলে জানালেন সিদ্দিক।
নূরে আলম সিদ্দিক বলেন, ‘প্রতিদিন ভোরে উঠেই আমি নিজে রাস্তা ঝাড়ু দিই, গাছের ডালপালা ছেঁটে দিই, ফুলগাছে পানি ছিটিয়ে দিই। মনে হয় সাতসকালে আমার সন্তানদের যত্ন নিচ্ছি, তাদের আদর করছি। যত দিন বেঁচে থাকব বকুলতলা মোড়কে সাজিয়ে যাব।’