শিশু কেন স্কুলে যেতে চায় না
স্কুলগুলোতে বার্ষিক পরীক্ষা প্রায় শেষ। শুরু হবে নতুন ক্লাসে ভর্তির প্রক্রিয়া। আবার এবারই হয়তো অনেক শিশু প্রথমবারের মতো স্কুলে ভর্তি হতে যাচ্ছে। স্কুল মানেই শিশুদের হইচই, কলরব আর দৌড়ঝাঁপ। কিন্তু ব্যতিক্রমও আছে। অনেক শিশুই স্কুলে যেতে অনীহা প্রকাশ করে। স্কুলে ঢুকতে বা ক্লাসে গিয়ে বসতেই চায় না। কান্নাকাটি করে। যেসব শিশু নতুন স্কুলে ভর্তি হচ্ছে তাদের মধ্যে এ প্রবণতা বেশি দেখা গেলেও অন্যদের যে হয় না, তা নয়। শিশু কেন স্কুলে যেতে চাইছে না, কারণগুলো বুঝে সে মতো ব্যবস্থা নিলে স্কুলের সময়টা আরও আনন্দময় হয়ে উঠবে।
যে শিশু আজ স্কুলে যাওয়া শুরু করছে, তাকে পরবর্তী বছরগুলোতে পড়াশোনার পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে। তাই এ সময়েই শিশুটিকে এসব বিষয়ে প্রস্তুত করতে হবে।
যে শিশুরা স্কুলে যেতে চায় না, তারা স্কুলে না যাওয়ার জন্য নানা রকম বাহানা দেখায়। অনেকে কান্নাকাটি করে। সাধারণত তারা স্কুল থেকে পালিয়ে কোথাও যায় না। বাসায় থাকতে চায়। তবে পড়ালেখায় অনাগ্রহই শিশুর স্কুলভীতির একমাত্র কারণ নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্কুলের পরিবেশ, সহপাঠীদের আচরণ, সামাজিক সমস্যা (যেমন বুলিং), এমনকি অভিভাবকের দৃষ্টিভঙ্গিও শিশুর স্কুলভীতির কারণ হয়ে উঠতে পারে।
অনেক শিশুই বিভিন্ন শারীরিক উপসর্গের (যেমন পেটব্যথা, মাথাব্যথা, বমি ইত্যাদি) অজুহাত দেয়। এসব উপসর্গ আবার স্কুল বন্ধের দিনে থাকে না এবং এর তীব্রতা শুধু স্কুলে যাওয়ার আগে আগে বোঝা যায়। এ ক্ষেত্রে বুঝতে হবে, কোনো কারণে শিশুটির স্কুলের প্রতি ভীতি বা অনাগ্রহ তৈরি হয়েছে। এটি শিশুদের একটি উদ্বেগজনিত মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, যা স্কুলভীতি নামে বেশি পরিচিত।
নতুন স্কুলে ভর্তির পর এমনিতেই শিশুর নতুন পরিবেশে নতুন বন্ধু তৈরিতে সময় লাগে। বন্ধু না তৈরি হওয়া পর্যন্ত শিশুর স্কুলে যেতে খারাপ লাগতে পারে।
এ ছাড়া ৭ থেকে ১১ বছর বয়সী অনেক শিশুর মধ্যে সেপারেশন অ্যাংজাইটি নামে একধরনের সমস্যা দেখা যায়। যে সমস্যায় শিশুরা বাসা বা আপনজন থেকে দূরে থাকাটা মেনে নিতে পারে না। যে বয়সে একটি শিশুর স্বাধীনভাবে একাকী চলাফেরা, খেলাধুলা ও বন্ধুদের সঙ্গে মেলামশার ক্ষমতা থাকার কথা, তা যদি না থাকে তখন সমস্যা দেখা যায়।
পড়াশোনার অতিরিক্ত চাপ, প্রতিদিন পরীক্ষা, খেলাধুলা বা বিনোদনের ব্যবস্থা কম থাকা, কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা, সবার সামনে অপমান ইত্যাদি শিশুর সংবেদনশীল মনে স্কুলের প্রতি অনীহা তৈরি করতে পারে।
অনেক শিশু সহপাঠীর মাধ্যমে শারীরিক বা মানসিকভাবে নাজেহাল হতে পারে। সাধারণত বিভিন্ন শারীরিক বৈশিষ্ট্য (উচ্চতা, শারীরিক গঠন, কথা বলার ধরন, গায়ের রং ইত্যাদি) নিয়ে অন্যরা শিশুদের বিব্রত করতে থাকে। অনেক সময় কোনো কোনো অভিভাবক, এমনকি কিছু শিক্ষকও এ রকম করে থাকেন। এ কারণেও ভুক্তভোগী শিশু স্কুলে যাওয়ার প্রতি তীব্র অনীহা দেখাতে পারে।
স্কুলে যাওয়া-আসার সময় কোনো খারাপ অভিজ্ঞতাও (ছিনতাই, দুর্ঘটনা, বখাটেদের উৎপাত ইত্যাদি) শিশুকে ভীত করে তুলতে পারে।
কখনো স্কুল বা সেখানে যেতে কোনো বাজে স্পর্শের শিকার হতে হয়েছে কি না, সেটিও কৌশলে জেনে নিতে হবে।
হঠাৎ স্কুল পরিবর্তন, এক শিক্ষা মাধ্যম থেকে আরেক মাধ্যমে ভর্তি হলে, দীর্ঘদিন কোনো কারণে স্কুলে অনুপস্থিত থাকলে, স্কুলের টয়লেটে যেতে সমস্যা হলে, ফল খারাপ হতে থাকলে বা এর জন্য বারবার তিরস্কার শুনতে হলেও স্কুলভীতি তৈরি হতে পারে।
প্রিয় শিক্ষকের পরিবর্তন, এমনকি কোনো নির্দিষ্ট শিক্ষকের বিরূপ আচরণের জন্যও শিশুর স্কুলে যাওয়ার প্রতি অনীহা দেখা দিতে পারে।
করণীয় কী
প্রথম স্কুলে যাওয়ার কিছুদিন আগে থেকেই শিশুকে স্কুলে যাওয়ার ব্যাপারে মানসিকভাবে প্রস্তুত করা প্রয়োজন। স্কুলে কী হয়, কারা থাকবে, কতক্ষণ সেখানে থাকতে হবে—এসব বিষয়ে বিভিন্ন গল্প করে আগে থেকে শিশুর মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে।
ক্লাসের বাইরে এমন জায়গায় অভিভাবক থাকতে পারেন যাতে শিশু আশ্বস্ত থাকে। টিফিন ব্রেকের সময় তাকে উৎসাহ দিতে পারেন।
অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা ও মেলামেশায় উৎসাহ দিতে হবে। এভাবে ধীরে ধীরে স্বাধীনভাবে স্কুলের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা তৈরি করতে হবে।
শিশু কেন স্কুলে যেতে চাইছে না, সে বিষয়ে অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
শিশুদের মধ্যেও বিভিন্ন ধরনের দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, শঙ্কা, কষ্ট ও আত্মসম্মানবোধ থাকে। তার আবেগ ও ভাবনা প্রকাশ করতে দিন।
অহেতুক কোনো ভীতি থাকলে সে বিষয়ে আশ্বস্ত করুন। স্পর্শকাতর কোনো বিষয় হলে অভিভাবককে শিশুদের মানসিকভাবে সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে শুধু নিজেদের মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা না করে স্কুল কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।