আপনার শিশু কি কোল থেকে নামতেই চায় না
ভেলক্রো বেবি এমন শিশু, যে সব সময় মা অথবা বাবার, বিশেষ করে মায়ের শরীরের সঙ্গে লেগে থাকতে চায়। ভেলক্রো মানে যেমন শক্তভাবে আটকে থাকা, ঠিক সেভাবেই শিশুরা মায়ের শরীরের সঙ্গে লেগে থাকতে চায়। এ ধরনের শিশুরা একমাত্র মা অথবা বাবার কোলেই শান্ত থাকে।
চেয়ারে বসে টেবিলে রাখা ল্যাপটপে এই লেখা যখন লিখতে বসেছি, তখন আমার আড়াই বছরের কন্যা আমার কোলে। নিয়ম ভেঙে ওকে মুঠোফোনে কার্টুন দেখতে দিয়েছি। সেটি সে আমার কোলে বসেই দেখবে। বিছানায়, কার্টুন আঁকা নরম মাদুরে ছড়ানো–ছিটানো খেলনা; কিন্তু সে কোল থেকে নামবে না।
এক রাতে ঘুম ভেঙে বাথরুমে গেছি। দরজা খুলে রীতিমতো আঁতকে উঠলাম। সামনে আমার কন্যা দাঁড়িয়ে চোখ মুছছে। আমি ওর পাশ থেকে বিছানা ছেড়ে উঠে আসায় সে-ও ওঠে, অল্প আলোয় মশারি থেকে বেরিয়ে বাথরুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
কন্যাকে নিয়ে যখন একটু হাঁটতে বের হই বা শপিংয়ে যাই, সে কোল থেকে নামবে না! জুতায় ময়লা লাগবে, নানা বাহানা। উপায় না দেখে ১০ কেজি অতিরিক্ত ওজন নিয়েই পথ চলি।
খেলনা দিয়ে বসিয়ে কোনো কাজে গেলে কিছুক্ষণ পরই শুরু হয়, ‘মা, পা ব্যথা করে। মশা কামড় দিছে। পিঁপড়া কামড় দিছে। খাটের নিচে একটা ডায়নোসর। মা পেটু (পেট) ব্যথা। পানি খাব…এই দেখো, একটা টিকটিকি। এদিকে আসো…।’ এক কথায়, সে আমার উপস্থিতি আর সক্রিয় মনোযোগ চায়। সে চায় না আমি তাকে রেখে কিছু করি।
সেদিন ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে দেখলাম, আমার কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বান্ধবী মুক্তা লিখেছেন, ‘ঘণ্টাখানেক ঘাড়ে নিয়ে হেঁটে হেঁটে ছোটবেলার সব মুখস্থ কবিতা পড়া শেষ করে, গুনগুনিয়ে বাচ্চাকে ঘুম পাড়ানো থেকে ঘুমন্ত বাচ্চাকে বিছানায় “ল্যান্ড করানো” বড় চ্যালেঞ্জ। এই নিয়ে তিনবার শোয়ালাম।’
মানে হলো, শিশুটি একা শোবে না। পাশে মাকেও শুয়ে থাকতে হবে। সে মায়ের শরীরের ওমে ঘুমাবে। না হলে শোয়ানোমাত্র উঠে যাবে, কাঁদবে।
আমার আরেক বান্ধবী সিঁথিরও একই হাল। সাত মাসের ঘুমন্ত সন্তানের পাশ থেকে ওঠার উপায় নেই। যতক্ষণ মা পাশে থাকবে, ততক্ষণ ‘তিনি’ নিশ্চিন্তে ঘুমাবেন। মা চোখের আড়াল হলেই চিৎকার জুড়ে দেবেন। মা হিসেবে সিনিয়র হওয়ায় ফ্রি উপদেশ দিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে লিখলাম, ‘নিজেকে একটু সময় দিস। নিজের যত্ন নিস। সবার আগে তোর নিজের শারীরিক আর মানসিক সুস্থতা। একটা বাবুর জন্য “হ্যাপি মা”য়ের চেয়ে বড় কিছু নেই।’
উত্তরে সে লিখল, ‘যেটুকু সময় গোসল করি, ওটাই আমার ‘মি টাইম’। তা–ও মিনিট দশেক পরই দরজায় ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে যায়। ওকে কেউ সামলাতে পারে না। আসলে ও কারও কাছে থাকে না।’
এ ধরনের শিশুদের ডাকা হয় ‘ভেলক্রো বেবি’
ভেলক্রো বেবি এমন শিশু, যে সব সময় মা অথবা বাবার, বিশেষ করে মায়ের শরীরের সঙ্গে লেগে থাকতে চায়। ভেলক্রো মানে যেমন শক্তভাবে আটকে থাকা, ঠিক সেভাবেই শিশুরা মায়ের শরীরের সঙ্গে লেগে থাকতে চায়। এ ধরনের শিশুরা একমাত্র মা অথবা বাবার কোলেই শান্ত থাকে।
অনেক সময় বাবার কাছেও থাকতে চায় না। মায়ের বুকে মাথা রেখে ঘুমায়। রাতে ঘুমানোর পরও ছোট্ট শরীরটা মায়ের শরীরের সঙ্গে জুড়ে রাখে। মা একটু পাশ ফিরে ঘুমালে সে–ও আঁতিপাঁতি করে মাকে খুঁজে নিয়ে আবার মায়ের দিকে হেলে পড়ে। ছোট্ট হাত দিয়ে মাকে খুঁজে না পেলে চোখ খুলে কাঁদতে শুরু করে। এমনকি অনেক সময় বাধ্য হয়ে শিশুকে নিয়েই টয়লেটে যেতে হয় মায়েদের!
এ তো গেল স্বাভাবিক সময়ের চিত্র। শিশুটি একটু অসুস্থ হলে তো কথাই নেই। অন্য কারও কাছে এই শিশুরা বেশিক্ষণ থাকতে চায় না। এ ধরনের শিশুর কাছে মা মানেই নিরাপদ আশ্রয়, মা মানেই শান্তি। এদিকে মায়ের কাছে ভেলক্রো বেবি হলো সীমাহীন ধৈর্য, ক্লান্তি আর পরিতৃপ্তিতে মোড়ানো, মায়া-মমতার বন্ধনে জড়ানো এক মাতৃত্বের অভিজ্ঞতা।
কেন এই শিশুরা এমন হয়
নিরাপত্তা ও আরামের খোঁজে: শিশুটি নিরাপদ বোধ করার জন্য, আরামের খোঁজে মা-বাবার যতটা সম্ভব কাছাকাছি থাকে। মায়ের কোলে শিশুরা সবচেয়ে নিরাপদ মনে করে। শিশু মায়ের সান্নিধ্যকে তার মানসিক এবং শারীরিক সুস্থতার জন্য অপরিহার্য মনে করে।
শক্তিশালী বন্ধন: এটি মা–বাবা ও শিশুর মধ্যে একটি স্বাস্থ্যকর ও শক্তিশালী বন্ধনের ইতিবাচক লক্ষণ।
বিকাশমূলক মাইলফলক: কিছু বিশেষ সময়ে, যেমন ৬ থেকে ৯ মাস, ১২-১৮ মাস বা অসুস্থতায় বা নতুন রুটিনের কারণে এমন আচরণ বেড়ে যেতে পারে।
ভেলক্রো বেবির মা-বাবার কী করণীয়
১. মনে রাখবেন, এই ভেলক্রো পর্যায় খুব বেশি দিন থাকবে না। সাধারণত তিন–চার বছরের মধ্যে পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। বিশেষ করে শিশু স্কুলে যাওয়া শুরু করলে তার আলাদা জগৎ তৈরি হতে থাকবে। ধীরে ধীরে আপনার ওপর নির্ভরশীলতা কমবে। তাই খুব বেশি ভাববেন না; বরং সময়টা উপভোগ করার চেষ্টা করুন। মনে রাখবেন, ‘দিস শ্যাল টু পাস’।
২. শিশুকে জড়িয়ে ধরে, কোলে নিয়ে, শারীরিক নৈকট্য বজায় রেখে তার নিরাপত্তার অনুভূতি দৃঢ় করুন।
৩. শিশুর সঙ্গে মানসম্মত সময় কাটান। ওকে সান্ত্বনা দিন, আশ্বস্ত করুন। ওর চাহিদা পূরণ করার চেষ্টা করুন।
৪. ধীরে ধীরে এ ধরনের শিশুকে স্বাধীন হতে উৎসাহিত করুন। একটু একটু করে ওদের বিশ্বস্ত কারও কাছে বা খেলনা বা খাবার দিয়ে একা ছেড়ে দিন। এতে ওদের আত্মবিশ্বাস বাড়বে।
৫. নিজের জন্য সময় বের করুন। নির্দ্বিধায়, নিঃসংকোচে অন্যের সাহায্য চান।
শিশুর এমন আচরণ স্বাভাবিক। এটি শিশুর স্বাভাবিক বিকাশের একটি পর্যায়। তাদের কাছে মা বা বাবার কোল একটি নিরাপদ আশ্রয়। এটি তাদের মানসিক ও শারীরিক প্রয়োজন পূরণ করে। বাইরের জগতের চাপ থেকে তাদের রক্ষা করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি কমে আসবে।
সূত্র: প্যারেন্টস