কেন্দ্রকাননের কুরচি-কথা

ঢাকার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ভবনের সামনেই ফুটেছে সাদা কুরচি ফুলছবি: তানিয়া আফরোজ

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের স্বজনদের কাছে এর ছোট্ট সবুজ প্রাঙ্গণটা মহুয়াতলা নামেই পরিচিত ছিল। বছর কয়েক আগে এক ঝড়ে মাটির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে উপড়ে যায় মহুয়া। কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তারপর থেকেই ভাবছিলেন কী গাছ লাগানো যায়। পরে প্রকৃতিপ্রেমী তুঘলক আজাদের পরামর্শে তাঁর এনে দেওয়া কুরচি ঠাঁই পায় কেন্দ্রপ্রাঙ্গণে। কেন্দ্রকাননে আরেক দুর্লভ ফুল অশোকগাছের কোল ঘেঁষে বসতি গেড়েছে কুরচি। গত বছর গুটিকতক ফুলে এলেও এ বছর এসেছে দল বেঁধে। সূর্যের পরশে তার ধবধবে সাদা রূপ যেন উপচে পড়ছে। আর সন্ধ্যার মৃদু বাতাসের সঙ্গে জানান দিয়ে যাচ্ছে তার সৌরভ। সন্ধ্যা থেকে রাতে ঢুকে পড়া আড্ডাগুলোয় কথার সঙ্গে কুরচির সুরভিও যেন মাখামাখি করে জড়িয়ে থাকে। সবুজ পাতার পটভূমিতে লাল অশোকের থোকার পাশে সাদা কুরচির থোকা জায়গাটুকুকে নয়নাভিরাম করে তুলেছে।

কেন্দ্রের বাগানে কুরচি
ছবি: তানিয়া আফরোজ

লাল আর ছাইরঙা ভবনের কোল ঘেঁষে একরত্তি সবুজ কাননে সুরভিত শুভ্রতায় মাতিয়ে তুলেছে বন-পাহাড়ের দুর্লভ ফুল কুরচি। লিকলিকে একহারা গাছটাতে থোকায় থোকায় ফুটে থাকা কুরচির শ্বেতশুভ্র সৌন্দর্য বইপ্রেমী দর্শনার্থীদের যেমন নজর কাড়ছে, তেমনি অন্যদের থামিয়ে দিচ্ছে ক্ষণিকের জন্য হলেও। স্বর্গের নন্দনকাননের ফুল কুরচি যেন তার সব রূপ নিয়ে হাজির কসমোপলিটন মনগুলোতে প্রকৃতিপ্রেমের পরশ বুলিয়ে দিতে।

কুরচি-কথা হবে আর কালিদাস, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল হবে না, তা কি হয়! মেঘকে কুরচির অর্ঘ্য দেওয়ার বাসনা জানিয়েছিলেন কালিদাস তাঁর ‘মেঘদূত’ কাব্যে। কুরচির পবিত্র সৌন্দর্যের বর্ণনায় আজ তাই ‘মেঘদূত’ চলে আসে যেন অবধারিতভাবে। রবীন্দ্রনাথের কুরচি-প্রেমের বহু নজির আছে। শিলাইদহ থেকে কলকাতা ফেরার পথে কুষ্টিয়া স্টেশনঘরের পেছনের দেয়ালঘেঁষা কুরচিকে দেখে তিনি লিখেছিলেন, পুরো গাছটি ফুলের ঐশ্বর্যে মহিমান্বিত। প্রচলিত গল্প আছে, ভ্রমর পদ্মকে ভুলে কুরচির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। সে অপরাধে অপরাধী হয় কুরচি। এই শ্রুতগল্প নিয়ে আস্ত একটি কবিতা লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ—‘কুরচি, তোমার লাগি পদ্মেরে ভুলেছে অন্যমনা/ যে ভ্রমর, শুনি নাকি তারে কবি করেছে ভর্ৎসনা।’ দুধসাদা রঙের সুগন্ধি এই ফুলটার প্রতি রবীন্দ্রনাথের আরও ভালোবাসার প্রমাণ মেলে নানা লেখায়।

কুরচি তার সব ঐশ্বর্য নিয়ে ফুটে আছে থোকায় থোকায়
ছবি: তানিয়া আফরোজ

কুরচির আরেক নাম গিরিমল্লিকা। এই নামে নজরুলও করেছেন কুরচি-বন্দনা—‘গিরিমল্লিকা কই? চামেলী পেয়েছি সই/ চাঁপা এনে দাও, নয় বাঁধব না চুল।’

বাংলা ক্যালেন্ডার মেনে এখন বৈশাখ বিদায় নিচ্ছে। সারা দেশের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার আনাচকানাচে এখন কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, জারুল, সোনালু ফুলে ছেয়ে আছে। ছুটে চলা নগরবাসীর মন একটু করে হলেও রঙিন করে তুলছে এসব ফুলের রং। রংবিলাসী ফুলদের এই শহরে বেশি দেখা যায় বলে তাদের নিয়ে আলোচনা বেশি হলেও পিছিয়ে নেই কুরচি। বাংলামোটর মোড়ের কোলাহল ছেড়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের গলিতে দাঁড়িয়ে সে রানি হয়ে আছে। ঢাকায় অবশ্য আরও কিছু কুরচির সন্ধান জানেন প্রকৃতিপ্রেমীরা।

পাহাড়ে রঙিন ফুলের সৌন্দর্য দেখে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ভেবেছিলেন, এই পাহাড়ে ফুলের সৌন্দর্য দেখার কেউ নেই, তবু ফুল তার সব ঐশ্বর্য উপচে দিচ্ছে। আসলে কে তার সৌন্দর্যে মাতোয়ারা হলো বা কে উপেক্ষা করল, তাতে ফুলের কিছু এসে যায় না। নগরীর বুকেও নিজের সমস্ত শুভ্রতামণ্ডিত সুরভি নিয়ে আপনমনে নিজের সৌন্দর্য ছড়িয়ে চলেছে কুরচি।

আরও পড়ুন