বিয়ের বায়োডাটায় কী কী থাকবে

সাধারণভাবে ‘বায়োডাটা’ বা ‘সিভি’ শব্দগুলো চাকরির সঙ্গেই বেশি সম্পর্কিত। কিন্তু এখন বিয়ের সম্বন্ধেও বর–কনের বায়োডাটার গুরুত্ব ক্রমেই বাড়ছে। পরস্পরকে জানা বোঝার জন্য বায়োডাটার তথ্যের সত্যতা শুধু বিয়ের জন্যই নয়, পরবর্তী সময়ে সুখী দাম্পত্যের জন্যও জরুরি বটে।

বিয়ের বায়োডাটা হওয়া চাই ব্যক্তিগত ও পারিবারিক তথ্য সমৃদ্ধ। মডেল: ললনা
ছবি: কবির হোসেন

বিয়ের কথাবার্তায় বর বা কনের সিভি না দিয়ে দিতে হবে বায়োডাটা।

প্রথমেই তাই সিভি (কারিকুলাম ভিটা) আর বায়োডাটার পার্থক্যটা জেনে নেওয়া ভালো। সিভি হলো একজন ব্যক্তির সংক্ষিপ্ত পরিচয়। যেখানে থাকে তাঁর উদ্দেশ্য বা ইচ্ছে কী, কেমন ক্যারিয়ার গড়তে চান, তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করার ধরন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ঠিকানা, পড়াশোনা, অর্জন, উৎসাহ, বিশেষ কোনো প্রতিভা, আগের কাজের অভিজ্ঞতা, রেফারেন্স ইত্যাদি, যার প্রায় সবটাই চাকরিকেন্দ্রিক। এটা একধরনের প্রফেশনাল বৃত্তান্ত।

আর বায়োডাটা মানুষটির আরও বিশদ বর্ণনা, যা দিয়ে মানুষটি ছাড়াও তাঁর পরিবার ও চারপাশ সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। বায়োডাটায় ব্যক্তি তাঁর পরিচয়, পেশা, পড়াশোনা, পরিবারের বাকিদের পরিচয়, ব্যক্তিগত নানা তথ্য—শখ, পছন্দ–অপছন্দ, দর্শন, অর্জন ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত দিতে চেষ্টা করেন।

বিয়ের বায়োডাটা

বর বা কনের বায়োডাটা হতে হবে এমন, যাতে বিয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো থাকে; মানুষটার সামাজিক, আর্থিক প্রভৃতি অবস্থা সহজে যাতে বোঝা যায়। বায়োডাটা দিয়ে আঁচ করা যায় মানুষটির জীবনধারা, চিন্তা, যোগ্যতা, সামাজিক মর্যাদা ইত্যাদি। এ ছাড়া পরিবারের অন্যদের সম্বন্ধে একটা ধারণা দেওয়া থাকলে কেমন পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধনে জড়াতে যাচ্ছেন, সেটাও বুঝে নিতে সুবিধা হয়।

বায়োডাটা দেখে যেন প্রকৃত মানুষটার বিষয়ে ধারণা পাওয়া যায়। মডেল: রাতুল
ছবি: কবির হোসেন

বিয়ের বায়োডাটার সঙ্গে সংযুক্ত ছবিটি হবে ফরমালি তোলা ইনফরমাল ছবি। সেলফিও নয়, আবার পাসপোর্টের মতো গুরুগম্ভীরও নয় এমন ছবি, যেটা ব্যক্তি আপনাকে (পাত্র–পাত্রী) তুলে ধরবেন। যে ছবি অন্য পক্ষের সবাই মিলে দেখতে পারবে। মনে রাখবেন, এই ছবি কিন্তু নতুন একটি পরিবারের কাছে আপনার সম্বন্ধে প্রথম একটা মনোভাব তৈরি করবে, তাই সঠিকভাবে সেটা তোলা চাই। অনেকে, বিশেষ করে বিয়ের পাত্রীরা, নিজের স্বাভাবিক গণ্ডির বাইরে গিয়ে বিয়ের ছবিতে অতিরিক্ত সামাজিকতার বিষয়টি মাথায় রাখেন। যেমন আপনি যদি হাতাকাটা ব্লাউজ বা পোশাকে স্বাচ্ছন্দ্য হন, নিয়মিত এমন পোশাক পরেন, তাহলে আপনার বিয়ের বায়োডাটার সঙ্গে এমন ছবিই যুক্ত করা উচিত। এতে বিয়ের পর নতুন পরিবারের কারও মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে না। কোনো পাত্র যদি অযথা লেখেন যে তিনি ঘুরতে খুবই ভালোবাসেন, কিন্তু বিয়ের পর দুই বছরে কোথাও গেলেন না, সেটা কিন্তু প্রতারণাই করা হবে। বরং আপনার বেড়াতে ভালো না লাগলে সেটাও উল্লেখ করতে পারেন।

বিয়ের বায়োডাটা ডিজিটাল মাধ্যমে দিলে সম্ভব হলে পারিবারিক একটা ভিডিও ক্লিপও যুক্ত করে দিতে পারেন।

অনেক ছেলে বা মেয়ের পরিবার ধর্মীয় বিধিবিধান মেনে চলার ব্যাপারে বেশ কড়া। তাঁরা কিন্তু সুন্দরভাবে বায়োডাটায় সেটি বুঝিয়ে দিতে পারেন। ছবিতেও সেটা স্পষ্ট রাখা জরুরি। কোনো পরিবার সাধারণ হলে আরেকটি পরিবার যদি অতি-আধুনিক হয়, তাহলে সেই দুটি পরিবার বিয়ের মতো বন্ধনে জড়াবে কি না, সেটা বায়োডাটা দেখে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। বিয়ের আগে কিছু বিষয় গোপন রাখলে বা চেপে গেলে বিয়ের পর খুবই খারাপভাবে সেটা সামনে আসতে পারে। এ ধরনের ঘটনা নতুন জীবনের শুরুতেই সম্পর্ককে বিষাক্ত করে তোলে। অথচ বায়োডাটা বা ছবিতে নিজের সঠিক পরিচয় তুলে ধরলে আখেরে দুই পক্ষের জন্যই সেটা হতো মঙ্গলকর।

আরও পড়ুন

 যেসব বিষয় রাখতেই হবে

বিয়ের বায়োডাটায় অবশ্যই রাখতে হবে, এমন কিছু তারকা চিহ্নিত বিষয় নিয়ে এবার আলোচনা করা যাক। ব্যক্তির নিজস্ব তথ্যের মধ্যে অবশ্যই থাকবে পূর্ণ নাম, জন্ম সাল, রক্তের গ্রুপ, বর্তমান এবং স্থায়ী ঠিকানা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, জেলার নাম, উচ্চতা। শহরে থাকলে সেটা ভাড়া না নিজেদের বাসা, সেটাও উল্লেখ করবেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ঠিকানাও দিতে পারেন বায়োডাটায়। মডেল: রাতুল
ছবি: কবির হোসেন

এ ছাড়া ফোন নম্বর, ই–মেইল, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের মতো সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করলে তার ঠিকানাও বায়োডাটায় দিতে পারেন। এই তথ্য সাধারণত প্রাথমিক নির্বাচনের পর বা নির্ভরযোগ্য হলে শুরুতেই বায়োডাটায় উল্লেখ করে দিতে পারেন।

কর্মক্ষেত্র ও পড়াশোনার জায়গাগুলোতে অবশ্যই সঠিক সাল–তারিখ লিখবেন। কর্মক্ষেত্রের প্রতিষ্ঠানের নাম, পদবি ও ঠিকানাসহ শাখার নাম উল্লেখ করবেন, অন্য পক্ষ চাইলে যাতে খোঁজ নেওয়া সহজ হয়।

পরিবারের বাকি সদস্য বলতে মা–বাবা এবং ভাই–বোনের নাম, পেশা অবশ্যই উল্লেখ করুন। ভাই–বোন বিবাহিত হলে তাঁদের সঙ্গীর তথ্যও উল্লেখ রাখুন। অনেকে দাদা-দাদি এবং নানা-নানির তথ্যও উল্লেখ করেন। সেটা দেওয়া ভালো। এতে পারিবারিক অবস্থা বুঝতে বা সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হয়। তবে পরিবারের একাংশের শিক্ষা ও অর্থিক অবস্থার প্রসঙ্গ অনেকে এড়িয়ে যান, বিশেষ করে তাঁরা যদি হন কম শিক্ষিত বা কম অবস্থাপন্ন। তবে আমার পরামর্শ হচ্ছে, প্রাথমিক কথাবার্তার পর হ্যাঁ–সূচক উত্তর এলে বায়োডাটা দেওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই পরিবারের এসব দিকও সততার সঙ্গে তুলে ধরা উচিত। এতে সেই পরিবার সবটা জেনেবুঝে বিয়েতে রাজি হলে বিয়ের পর তাদের আচরণেও কোনো পরিবর্তন হবে না। তাতে বর বা কনে অন্য পরিবারের সঙ্গে মানিয়ে নিতে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকেন।

বায়োডাটার তথ্য দেখে এক পরিবার অন্য পরিবারের সঙ্গে মানিয়ে নিতে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকেন। মডেল: ললনা
ছবি: কবির হোসেন

এসব তথ্য সঠিকভাবে না দেওয়া এবং জানাবোঝার অভাবেই সাধারণত বিয়ের পর সম্পর্কে তিক্ততা তৈরি হয়, ঘটে বিচ্ছেদ। এসব বিষয়ে মানুষ যদি ঠিকমতো মূল্যায়ন করে, তাহলে ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলা সহজ হবে।

প্রফেশনাল অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, বর্তমান সময়ে পাত্র বা পাত্রী পছন্দ হলে পরিচয়ের গভীরতায় আর যেতে চায় না অন্য পক্ষ, বদলে তারা বড্ড তাড়াহুড়া করে। যে কারণে পরিচয় হালকা হলেও বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় তারা, অনেক ক্ষেত্রেই যা আর দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কে রূপ নিতে পারে না। বিয়ের বায়োডাটা যদি অসমাপ্ত বা অস্পষ্ট থাকে, তাহলে গঠনগতভাবেই হালকা হয় সম্পর্কের ভিত্তি।

সারা জীবনের জন্য বিয়ে। অল্প পরিচয়, মোহে পড়ে সেই সম্পর্ক তৈরি না করে বিস্তারিত খবর জেনেই বিয়ের সিদ্ধান্ত নিন।