শীতে বরফ আর শরতে লাল পাতায় ঢেকে যায় যে ক্যাম্পাস

বিশ্বের নানা বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ছেন বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনোটা শত বছরের পুরোনো, কোনোটায় শিক্ষক হিসেবে আছেন একাধিক নোবেলজয়ী অধ্যাপক। স্বনামধন্য এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অভিজ্ঞতা কেমন? পড়ুন ব্রাউন ইউনিভার্সিটির পিএইচডি শিক্ষার্থী আশফাক আহমেদ–এর লেখা।

ব্রাউন ইউনিভার্সিটির পিএইচডি শিক্ষার্থী আশফাক আহমেদ
ছবি: আশফাক আহমেদের সৌজন্যে

ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়া বেশ কঠিন। বলা হয়, এখানে ভর্তির হার ৪ শতাংশের কম। অর্থাৎ এক হাজার জন আবেদন করলে নির্বাচিত হন ৪০ জনের কম। এখানে আসার পেছনে আমার পথটা কঠিন ছিল সত্যি, তবে সেটি আরও কঠিন হতে পারত। হয়নি তিনটি কারণে।

প্রথমত, আম্মু-আব্বুর সমর্থন। বাংলাদেশের অধিকাংশ ছেলেমেয়েই স্নাতক শেষ বর্ষে এসে একটা অদ্ভুত দ্বিধায় পড়েন—চাকরিতে ঢুকব, নাকি বিদেশে পড়তে যাব? অনেকে ঘরে বসেই কিছুদিন সময় নিয়ে জিআরই, টোয়েফল, আইইএলটিএস পরীক্ষা দিয়ে প্রস্তুতি নেয়, তবে সবার এই সুযোগ থাকে না। কারও কারও কাছে এটুকু সময়ও ‘বিলাসিতা’। আমার খুব সৌভাগ্য, আর্থিকভাবে খুব সচ্ছল না হওয়ার পরও আম্মু-আব্বু আমাকে এ সাহসটা দিয়েছেন।

দ্বিতীয়ত, স্নাতকে যেই অধ্যাপকের সঙ্গে আমরা থিসিস পেপারের (গবেষণাপত্র) কাজ করি, তাঁর পরামর্শ অনুসরণ করলে এবং তাঁর কাছ থেকে শক্তিশালী সুপারিশপত্র পেলে ফান্ড পাওয়ার পথ অনেকটাই সুগম হয়। আমি এ ক্ষেত্রে ধন্যবাদ দিতে চাই বুয়েটের অধ্যাপক মোহাম্মদ নাসিম হাসানকে।

আরও পড়ুন

তৃতীয়ত, অনেক সময় ফান্ডিংয়ের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে ই–মেইল করে তাঁর সঙ্গে কাজের আগ্রহ প্রকাশ করতে হয়। সিভি, অতীতের কাজের অভিজ্ঞতা, আগ্রহের বিষয়, অনেক কিছুই ই–মেইলে ছোট করে প্রাঞ্জল ভাষায় বর্ণনা করতে হয়। এই একটি ই–মেইল ঠিকঠাকভাবে লিখতে পারেন না বলেই অনেকেই আটকে যান। এ ক্ষেত্রে আগে ফান্ড পেয়েছেন, এমন কারো ই–মেইল দেখে ধারণা নিতে পারলে ভালো হয়। এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করেছিলেন বুয়েটের পুরকৌশলী ওয়াসিক আমীন ভাই।

এতসব সহায়তা পেয়েছিলাম বলেই এখন আইভি লিগভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার সুযোগ পাচ্ছি।

আশফাক আহমেদ
ছবি: আশফাক আহমেদের সৌজন্যে

ক্যাম্পাসের প্রথম দিনটা ছিল অসাধারণ। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন ব্যক্তিগতভাবে এসে হাত মিলিয়েছেন, কথা বলেছেন, আমাদের নিয়ে তাঁর প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন। ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস খুব বড় নয়, তবে অসম্ভব সুন্দর! বিশ্ববিদ্যালয়টা আটলান্টিক মহাসাগরের খুব কাছে। সপ্তাহান্তে সমুদ্রের পাড়ে বসে বই পড়তে ভালো লাগে। এখানে বছরে চারটি ঋতু। প্রতিটি ঋতুই নিজস্ব সৌন্দর্য নিয়ে ধরা দেয়। শীতে ক্যাম্পাস সাদা বরফে ঢেকে যায়, শরতে ছেয়ে যায় লাল পাতায়।

ব্রাউনের প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্যই একজন বিশেষজ্ঞ মনোবিদ ও চিকিৎসক বরাদ্দ থাকে। কাজের চাপ বা মানসিক চাপ বেড়ে গেলে তাঁদের পরামর্শ নেওয়া যায়। তাঁরাও সাহায্য করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে বছরজুড়ে সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত বিনা মূল্যে যাতায়াতসেবার ব্যবস্থা থাকে। বিশেষ আবেদন করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাইনিংয়ে বিনা মূল্যে খাবারও পাওয়া যায়।

তবে সবচেয়ে অবাক করেছে এখানকার ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক। ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের মধ্যে বিশ্বখ্যাত লেখক থেকে শুরু করে নোবেলজয়ীও আছেন; কিন্তু তাঁরা যখন আমাদের ক্লাস নেন, কিংবা ক্লাসের বাইরে আমাদের খোঁজখবর নেন, মনেই হয় না তাঁরা এত বড় মাপের মানুষ। একদিন এক অধ্যাপককে প্রশ্ন করেছিলাম, এমন সম্পর্ক তাঁরা কেন বজায় রাখেন? তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যদি তোমাকে আমার কলিগ মনে করে কথা না বলি, সারা জীবন নিজেকে তুমি ছাত্রই ভাববে। কখনো অধ্যাপক ভাবতে পারবে না।’

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে বহু পার্থক্যই এখানে চোখে পড়বে। সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো শিক্ষার্থীর সংখ্যা। আমাদের দেশে জনসংখ্যা অনেক বেশি। তাই স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদাভাবে কাউকে গড়ে তোলার দায়িত্ব নেওয়া শিক্ষকের পক্ষে সম্ভব হয় না; কিন্তু এখানে একজন অধ্যাপক তিন–চারজন পিএইচডি বা মাস্টার্সের শিক্ষার্থীকে একান্ত মনোযোগের সঙ্গে গড়ে তুলতে পারেন। এ ছাড়া এখানে আধুনিক মানের গবেষণাগার আছে, অনলাইন লাইব্রেরিতে অবাধে পড়াশোনার সুযোগ আছে, দেশে এসব সুবিধা আমি পাইনি।

প্রায় সাড়ে চার বছর ধরে এখানে পড়ছি। বেশ কিছু পালাবদল দেখেছি। এখন দেখছি, ব্রাউনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ও নেতৃত্বের দক্ষতা। আইভি লিগের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্ব গড়ে তুলতে পছন্দ করে। ভূরাজনীতি, অর্থনীতি, কূটনীতি, সাহিত্য, গণমাধ্যম, পপ কালচার—যেকোনো ক্ষেত্রেই সেটি হতে পারে। এআইয়ের হাত ধরে পুরো পৃথিবী যে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, ব্রাউন ইউনিভার্সিটি সেটি বিবেচনা করেই এই দুটি বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে।

আরও পড়ুন