তাঁরা প্রতিবাদ করেছেন

১৭ জুলাই রাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে পাঁচ তরুণের হাতে যৌন নিপীড়ন ও মারধরের শিকার হন এক ছাত্রী। এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে, বিচার হয়নি। তাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ওপর আস্থা রাখতে পারেননি শিক্ষার্থীরা। রাতেই প্রতিবাদে এককাট্টা হন মেয়েরা। তাঁদের সঙ্গে কণ্ঠ মেলায় আরও অনেকে। প্রতিবাদকারীদের সঙ্গে কথা বলেছেন সুজয় চৌধুরীমোশাররফ শাহ্

‘ঘটনাটি প্রথমে শুনি ফেসবুকে। স্ট্যাটাস দিয়ে এক বন্ধু জানান, এক ছাত্রীকে রাতের বেলা বিবস্ত্র করে নিপীড়ন করা হয়েছে। ভিডিও ধারণ করা হয়েছে। শোনার পর শরীর হিম হয়ে যায়। এমন অকল্পনীয় ঘটনা ক্যাম্পাসের ভেতরেই ঘটে গেছে। ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। ভাবতে থাকি এ ঘটনার প্রতিবাদ জানাতেই হবে। এরপর ছাত্রীদের আন্দোলন শুরু হলো। সেখানে যোগ দিলাম।’ বলছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী ফারজানা আমিন। প্রীতিলতা হলে থাকেন তিনি। ১৭ জুলাই রাতে এক ছাত্রীকে নিপীড়নের ঘটনার পর ওই হল থেকেই প্রথম ছাত্রীরা বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করতে বের হন। সেখানে ছিলেন ফারজানা আমিন। ওই দিনের ঘটনার কথা উল্লেখ করে এই আন্দোলনকারী বললেন, ‘ক্যাম্পাসের ভেতরেই গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর দুই ছাত্রীকে হেনস্তা করা হয়েছিল। কিন্তু ওই ঘটনার বিচার হয়নি। আবার আরেক ছাত্রী যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার পর প্রশাসনের ওপর ভরসা রাখতে পারিনি। শুরু হয় আন্দোলনের প্রস্তুতি।’

আরও পড়ুন

ফারজানা বলেন, বুধবার দুপুর থেকেই ছাত্রীরা প্রতিবাদী কর্মসূচির বিষয়ে ভাবতে থাকেন। এর মধ্যে এক ছাত্রী পরিচয় গোপন করে ফেসবুক গ্রুপে রাত ১০টায় হল থেকে বের হয়ে কর্মসূচি করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ খবর জেনে যায়। রাত সাড়ে ৯টার দিকেই বের হয়ে যান তাঁরা। ঠিক ওই সময় প্রক্টরিয়াল বডি চলে আসে। পরে আন্দোলন না করতে নির্দেশ দেয়। তবে এ নির্দেশনা তাঁরা মানেননি। সবাই মিলে চলে যান উপাচার্যের বাসভবনের সামনে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী নিপীড়নের ঘটনার পর প্রথমে ছাত্রীরাই বিক্ষোভ শুরু করেন
ছবি: জুয়েল শীল

নিপীড়নের ঘটনার বিচারের দাবিতে হল থেকে বের হয়েছিলেন কয়েক শ ছাত্রী। আশপাশের কটেজ-মেসের ছাত্রীরাও হাজির হয়েছিলেন উপাচার্যের বাসভবনের সামনে। ফারজানা আমিন ছাড়াও সে দলে ছিলেন পদার্থবিদ্যা বিভাগের ইসরাত হক ও আশরাফী নিতু, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ফারহানা আকতার, ইংরেজি বিভাগের তাসফিয়া জাসারাত।

আরও পড়ুন

যেভাবে সূত্রপাত

১৭ জুলাই রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেন এলাকায় পাঁচ তরুণের হাতে যৌন নিপীড়ন ও মারধরের শিকার হন এক ছাত্রী। ওই ছাত্রীকে বেঁধে বিবস্ত্র করে মুঠোফোনে ভিডিও ধারণ করা হয়। এ সময় তাঁর সঙ্গে থাকা এক বন্ধু প্রতিবাদ করলে তাঁকেও মারধর করেন ওই পাঁচ তরুণ। ঘটনার দুই দিন পর প্রক্টরের কাছে অভিযোগ দেন ওই ছাত্রী। ওই দিন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নির্দেশনা দিয়ে বলে, সব ছাত্রীকে রাত ১০টার মধ্যে হলে প্রবেশ করতে হবে।

এসব ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর বুধবার থেকেই উত্তাল হয়ে পড়ে ক্যাম্পাস। রাতেই ইসরাত, সোনিয়া, ফারহানারা হল থেকে বের হয়ে আন্দোলন শুরু করেন। সেখানে তাঁরা চার দফা দাবি তুলে ধরেন। ঘটনার রেশ ধরে বৃহস্পতিবারও আন্দোলনে জারি রাখেন শিক্ষার্থীরা। এদিন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে কর্মসূচিতে অংশ নেন ১২ জন শিক্ষক।

অন্যতম আন্দোলনকারী ইসরাত হক বলেন, যৌন হেনস্তা ও নিপীড়নের মতো ঘটনা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন পরপর ঘটছে। বেশ কিছুদিন ধরেই শাটলে-বাসে হেনস্তার শিকার হচ্ছিলেন ছাত্রীরা। আগের ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাননি হেনস্তা ও নিপীড়নকারীরা। এবার ক্যাম্পাসের ভেতরেই ন্যক্কারজনকভাবে এক ছাত্রীকে নিপীড়ন করা হলো। ফলে আর ঘরে বসে থাকা গেল না।

আন্দোলনের শুরু থেকেই নেতৃত্ব দিয়েছেন পদার্থবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী আশরাফী নিতু। কখনো স্লোগান দিয়েছেন, কখনো প্ল্যাকার্ডে লিখেছেন, আবার কখনো বক্তব্য দিয়েছেন। বুধবার রাতের আন্দোলনের এক ভিডিওতে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে চার দফা দাবি তুলে ধরছেন তিনি। আশরাফী নিতু বললেন, সব অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার, আগের তিনটি ঘটনার বিচার, যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ কেন্দ্রকে কার্যকর করা এবং ক্যাম্পাসে ২৪ ঘণ্টা নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা—এ চার দাবি নিয়েই শুরু হয় মূল আন্দোলন।

সহপাঠীর বিচারের দাবিতে মাঠে নেমেছেন ইসরাত, আশরাফী, ফারহানারা। সহপাঠীর সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনায় স্লোগান দিয়েছেন। তাঁদের প্রতিবাদ-বিক্ষোভের মুখেই পাঁচ আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে কর্তৃপক্ষ। তাঁদের মধ্যে দুজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। পরে তাঁদের আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়। গতকাল চার দফা দাবিও মেনে নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। দাবি আদায় হওয়ায় আন্দোলন থেকে সরেও এসেছেন আন্দোলনকারীরা। ফারহানা আকতার বলেন, আন্দোলনে এত ছাত্রী যোগ দেবেন, তা ভাবনাতেও আসেনি। কিন্তু প্রায় সব ছাত্রী স্বতঃস্ফূর্তভাবে বের হয়ে এসেছেন।