নাড়ুতে মায়ের হাতের ছোঁয়া পড়ে না বলেই ভেতরের টানটাও আর অনুভব করি না

সবার জন্য নাড়ুর আয়োজন থাকে কেবল লক্ষ্মীপূজায়
ছবি: প্রথম আলো

সব পূজাতেই কিছু না কিছু নাড়ু-মোয়ার আয়োজন থাকে। সাধ্যমতো পিঠাপুলি আর ক্ষীর–পায়েসও হয়। তবে সবার জন্য নাড়ুর আয়োজন থাকে কেবল লক্ষ্মীপূজায়। আমাদের এলাকায় অবশ্য সবই—লাড়ু। আরও একটু নিজের করে নিতে একে ‘লাড্ডু’ বলা যেতেই পারে। এদিকে বইয়ের পাতায় দেখি ঘরের লাড়ু মুখের ল-কে ন-করে বসে আছে। যেন বেড়াতে যাওয়ার পোশাকটা গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে। তাই সবার সামনে ডাকনামে আর ডাকি না, বলি নাড়ু। মোয়া শব্দের সঙ্গে আমাদের লাড়ুর যে আত্মীয়তা আছে, এ খবর আমাদের জানাই ছিল না।

পূজা ছুঁই ছুঁই দিনগুলোতেই শুরু হতো আয়োজনের ঘটা। আমাদের নিতাই দাদা গাছ থেকে নারকেল নামিয়ে ছোবড়া ছাড়িয়ে চেঁছে রেখে দিয়েছেন সেই কবে। বাড়ির পুরোনো কুরুনিটা দিয়ে মা যখন নারকেলটাকে বাঁ হাতে রেখেই ফট করে দুভাগ করলেন, তখনই যেন পূজার ঢাকে প্রথম কাঠি পড়ল।

একটা থালায় উঁচু করে রাখা হয়েছে কোরানো নারকেল। এদিকে কাদামাটির আদরে স্ফীত পেটখানা ঢেকে মাটির উনুনে যখনই চড়ে বসে পৌনে তিন পুরুষের কাঁসার কড়াই, অমনি আমরা দুই ভাইবোনও একপাশে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ি। মায়ের মনোযোগ তখন আঁচের দিকে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে লাফিয়ে জ্বলতে থাকে হলদেটে লালমুখো আগুন। ছায়া ফেলে আমাদের মুখে। বেশ খানিকটা লাফিয়ে দমফাটা হয়ে এলে গুড়ে জ্বাল আসে। কড়াইজুড়ে তখন নরম হয়ে ছড়িয়ে বসে পাটালি গুড়। ছোট ছোট বুদ্‌বুদ তুলে উপচে ওঠে। থালায় রাখা কোরানো নারকেলের জন্য কিছুটা চটচটে হয়ে আসে মায়ের আঙুল আর কাঠের হাতা। গরম গুড়ের ঘ্রাণ ততক্ষণে ঘর ছেড়ে শীতের হাওয়ায় গিয়ে মিশেছে। ম-ম সুবাস হেঁশেল থেকে শোবার ঘর, পটিকোঠা, বারান্দা, এমনকি উঠান পেরিয়ে পাড়াপড়শির কাছেও পৌঁছে দেয় পূজার আগমনী।

অনেকক্ষণ মাখামাখি শেষে গুড়ে–নারকেলে তখন একাকার। নিজের সুরভিত গৌরব নিয়ে নেচে নেচে তার সঙ্গে গিয়ে মেশে এলাচিগুঁড়া। মায়ের নরম হাতে উঠে দুই তালুতে পরম যত্নে এবার গোল হওয়ার পালা। নাড়ু তো নয়, মায়ের হাতে যেন একেকটা গ্রহই গোল গোল ঘুরে নিজেদের আকার নিচ্ছে। ঠান্ডা হলে ভেতরটা নরম রেখেই নিজেদের সঙ্গে এঁটে থাকে। তারপর কাচের বয়ামে ভরে উঁচু তাকের একপাশে রাখা হলো। ছোট্ট আমার চোখ ওটার দিকে থাকলেও অত উঁচু হাতের নাগালে আসে না, তাই ওটা আর ‘ছেলের হাতের মোয়া’ হয়ে ওঠে না।

রকম ফেরে কত পদের নাড়ুই না তৈরি করা হয়। তিল, নারকেল, মুড়ি, খই, চিড়ার নাড়ু থেকে শুরু করে হোমিওপ্যাথির ছোট ছোট বড়ির মতো সাদা ধবধবে শালুক ফুলের বীজের খই দিয়ে তৈরি ঢ্যাপের মোয়া, আহ কী স্বাদ! শুনেছি পদ্মফুলের বীজ থেকেও খই হয়, বানানো হয় মোয়া। আমাদের কখনো চেখে দেখা হয়নি।

সময়ের হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে এখন আমরা দোকানে সাজানো প্যাকেটবন্দী নাড়ুর যুগে এসে হাজির হয়েছি। বাবার বুকপকেটে ভাঁজ করা ছোট কাগজের সঙ্গে রাখা টাকায় নয়, আমাদের কালে চামড়ার মানিব্যাগে টান করে রাখা টাকায় চাইলেই পাওয়া যায় এই নাড়ু। শুধু কাগুজে টাকা নয়, ক্রয়ক্ষমতার এই টান টান সময়েও চাইলে খুঁজতেই পারি সেই নাড়ু, তবে সেখানে মায়ের হাতের ছোঁয়া পড়েনি বলেই হয়তো বুকের ভেতরের টানটাও আর অনুভব করি না।