জাপানে ভূমিকম্পে পরিবারের সবাইকে যেভাবে হারালেন নাওয়ুকি তেরামোতো

নাওয়ুকি তেরামোতো ভূমিকম্পে পরিবারের ১০ সদস্যকে হারান
ছবি: জাপান টাইমস

নাওয়ুকি তেরামোতো জাপানের একজন নার্সিং হোম ওয়ার্কার। কাজ করেন ইশিকাওয়া প্রশাসনিক অঞ্চলের কানাজাওয়া শহরে। একসময় স্ত্রী, ছেলেমেয়ে নিয়ে হাসিখুশি একটি পরিবার ছিল তাঁর। কিন্তু এখন প্রাণঘাতী ভূমিকম্পে পরিবার হারানোর দুর্বিষহ স্মৃতি বুকে নিয়ে কোনোরকমে বেঁচে আছেন ৫৪ বছর বয়সী নাওয়ুকি।
২০২৪ সালে নোটো উপদ্বীপে নববর্ষের দিনে আঘাত হানা সেই ভূমিকম্পে পরিবারের ১০ সদস্যকে হারান তেরামোতো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দুঃখও সহনীয় হয়ে আসে।

আরও পড়ুন
ভূমিকম্পের পর ধ্বংসাবশেষ
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

একসময় মানসিক শক্তি ফিরে পেলেও প্রিয়জন হারানোর ক্ষত হৃদয়ের গভীরে স্থায়ী ছাপ রেখে যায়।  দীর্ঘ এক বছরের নীরবতার পর সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারের দুঃসহ কষ্টের গল্প ভাগ করে নিয়েছেন তেরামোতো। তিনি বলেন, তিনি চান না মানুষ সেই ট্র্যাজেডির কথা ভুলে যাক। ভয়ংকর সেই দুর্যোগের পর গত এক বছর হারানো পরিজনদের বিষয়ে কথা বলা এড়িয়ে চলতেন তিনি। তারপর একপর্যায়ে ভূমিকম্পকবলিত এলাকায় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি।

তখন থেকেই নিজের পরিবারে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক সেই ঘটনার কথা সবাইকে বলতে শুরু করেন। তেরামোতো জানান, এটি তাঁকে কষ্টের মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহস জোগায়।
১ জানুয়ারি ২০২৪। তেরামোতোর ৫৩ বছর বয়সী স্ত্রী হিরোমি এবং তাঁদের চার সন্তান, শ্বশুর–শ্বাশুড়ি ও তেরামোতোর শ্যালকের পরিবার ইশিকাওয়া অঞ্চলে হিরোমির নিজ শহর আনামিজুতে জড়ো হয়েছিল। কানাজাওয়া শহরে কর্মরত তেরামোতোরও সেদিন কাজ শেষে তাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিকেল ৪টা ১০ মিনিটে তাঁর শিফট শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ আগে আঘাত হানে ৭ দশমিক ৬ মাত্রার একটা ভূমিকম্প। বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় যোগাযোগব্যবস্থা। রাস্তাঘাট চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ায় তিনি পরিবারের কাছে পৌঁছাতে পারেননি। তেরামোতো ভেবেছিলেন, সবাই হয়তো কোথাও নিরাপদে আছে। কিন্তু ৪ জানুয়ারি তিনি খবর পান যে তাঁর শাশুড়ির মৃতদেহ পাওয়া গেছে।

২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি জাপানে আঘাত হানে ৭ দশমিক ৬ মাত্রার একটা ভূমিকম্প
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

পরদিন সকালে আনামিজুতে পৌঁছে ভূমিকম্পের কারণে ভূমিধসে চাপা পড়া বাড়িটি দেখতে পান তেরামোতো। তাঁর শ্বশুর ও ২১ বছর বয়সী ছেলে শুঙ্কির মৃতদেহও একই দিনে পাওয়া যায়। ৭ জানুয়ারির মধ্যে তাঁর পরিবারের বাকি সদস্যদের মৃত্যুর কথাও নিশ্চিত হওয়া যায়। তাঁদের মধ্যে ছিলেন তেরামোতোর স্ত্রী ও বাকি তিন সন্তান। ২৩ বছর বয়সী রিউসেই, ১৯ বছর বয়সী কিয়োয়া এবং একমাত্র মেয়ে ১৫ বছর বয়সী মিওন।

কিয়োয়া জানুয়ারির দ্বিতীয় সোমবারে অনুষ্ঠেয় জাপানের সাবালকত্বপ্রাপ্তির অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন আর মিওনের মার্চে জুনিয়র হাইস্কুল থেকে স্নাতক হওয়ার কথা ছিল। তেরামোতো দুঃখ করে জানান, সেই অর্থে পরিকল্পিত পারিবারিক ভ্রমণ তাঁদের কখনোই করা হয়নি। একসঙ্গে তাঁদের শেষ স্মৃতি ছিল ২০২৩ সালে টোকিও ডিজনিল্যান্ডে গ্রীষ্মকালীন ভ্রমণ।

এই নির্মম ঘটনার বর্ণনা দেওয়ার সময় আবেগে তেরামোতোর কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসছিল। ঘটনার পরবর্তী এক বছরের বেশির ভাগ সময় তিনি ধ্বংসাবশেষ পরিষ্কার ও দুর্যোগপরবর্তী অন্যান্য দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চেয়েছেন। তিনি জানান, এসব কাজে নিজেকে এতটাই নিয়োজিত রেখেছিলেন যে শোক করার সময় ছিল না।

আরও পড়ুন
রাস্তাঘাট চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ায় তেরামোতো পরিবারের কাছে পৌঁছাতে পারেননি।
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

কিন্তু ভূমিকম্পের প্রথম বর্ষপূর্তিতে এক স্মরণসভায় প্রথমবারের মতো তেরামোতো তাঁর হৃদয়বিদারক অভিজ্ঞতার কথা জনসমক্ষে বলতে শুরু করেন। তিনি বলেন, হয়তো তাঁর এ গল্প ভূমিকম্পের ব্যাপারে মানুষকে সচেতন ও সতর্ক করবে। ক্ষয়ক্ষতির শিকার মানুষের মনে বেঁচে থাকার সাহস জোগাবে। আর যদি তা–ই হয়, তাহলে নিজের জীবনের দুঃখজনক ইতিহাস বলে যেতে চান তেরামোতো।
নিজের অঞ্চলের বাইরেও এখন জীবনের গল্প শোনাতে যান তেরামোতো। তবে ভূমিকম্পের ১৮ মাস পর জনসাধারণের আগ্রহ কমে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন তেরামোতো। তিনি বলেন, মনে হচ্ছে মানুষ ভূমিকম্পের ভয়াবহতার কথা ভুলতে শুরু করেছে। তাই পরিবারের স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে এবং মানুষকে ভূমিকম্পের ভয়াবহতার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে নিদারুণ সেই কষ্টের গল্প বলে যেতে চান তিনি।

সূত্র: জাপান টাইমস

আরও পড়ুন