সবজি দেখলেই ভয় পান? তাহলে আপনারও আছে ল্যাকানোফোবিয়া
খাবারের পাতে সবজি দেখলেই কারও কারও চোখেমুখে একধরনের আতঙ্ক ফুটে ওঠে। কিংবা বাজারে গেলে যেখানে সবজি বিক্রি হয়, সেই জায়গা তাঁরা এড়িয়ে চলেন। কখনো আবার সবজি দেখলেই ভীষণ মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। এটা একধরনের ফোবিয়া। এর নাম ল্যাকানোফোবিয়া। গ্রিক শব্দ ‘ল্যাকনো’ অর্থ সবজি আর ‘ফোবোস’ মানে ভয় বা বিতৃষ্ণা। এটি একটি বিরল মানসিক সমস্যা।
গবেষণায় দেখা গেছে, শস্য, ফল ও সবজিসমৃদ্ধ খাবার মানসিক উদ্বেগ কমাতে সাহায্য করে। অন্যদিকে প্রক্রিয়াজাত খাবার ও অতিরিক্ত চিনি উদ্বেগ বাড়ায়। কিন্তু ল্যাকানোফোবিয়ায় আক্রান্ত কিছু ব্যক্তি সবজির কাছাকাছি গেলেই এমন ভয়ানক আতঙ্কে ভোগেন যে তাঁদের হাসপাতালেও ভর্তি হতে হয়।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১ কোটি ৯০ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি কোনো না কোনো ধরনের ফোবিয়ায় ভোগেন এবং নারীরা পুরুষদের তুলনায় দ্বিগুণ হারে আক্রান্ত হন।
ল্যাকানোফোবিয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো পুষ্টিহীনতা। সবজি এড়িয়ে চলার ফলে শরীর প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজ থেকে বঞ্চিত হয়। মানসিক স্বাস্থ্যের ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টায় শারীরিক স্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ল্যাকানোফোবিয়ার উপসর্গ
চরম পুষ্টিহীনতার পাশাপাশি এই ফোবিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা অনেক সময় বাজারে সবজি দেখলেই যুক্তিসংগতভাবে চিন্তা করতে পারেন না। কেউ সবজি এড়িয়ে চলেন, কেউ নিজেকে বোঝান যে সবজি স্বাস্থ্যকর নয়, আবার কেউ সবজির অস্তিত্বই অস্বীকার করেন।
এসব সবজি থেকে নিজেকে দূরে রাখার একধরনের মানসিক উপায়। সামগ্রিকভাবে সবজির উপস্থিতিতে আতঙ্কিত হওয়া এবং প্যানিক অ্যাটাক হওয়া একটি সাধারণ উপসর্গ।
ল্যাকানোফোবিয়ার কারণ
এর নির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি। তবে পরিবেশ ও বংশগত প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বলে ধারণা করা হয়। যাঁদের পরিবারে মানসিক অসুস্থতা বা উদ্বেগজনিত সমস্যা আছে, তাঁদের এ ধরনের ফোবিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।
ট্রমাটিক বা মানসিক আঘাতমূলক কোনো ঘটনা অনেক সময় এই ভয়কে পুরোপুরি সক্রিয় করে দিতে পারে। তাই চিকিৎসার সময় রোগীর পারিবারিক ও পরিবেশগত ইতিহাস জানা থেরাপিস্টের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ল্যাকানোফোবিয়ার চিকিৎসা
এই রোগের জন্য কোনো একক চিকিৎসাপদ্ধতি সবার ক্ষেত্রে কার্যকর নয়। দুই ব্যক্তি একই ফোবিয়ায় আক্রান্ত হলেও তাঁদের প্রয়োজন, লক্ষ্য ও প্রতিক্রিয়া ভিন্ন হতে পারে। চিকিৎসকেরা সাধারণত নানা থেরাপি ও ওষুধ একত্রে প্রয়োগ করে সবচেয়ে উপযুক্ত পদ্ধতি খুঁজে নেন।
এক্সপোজার থেরাপি
ফোবিয়া নিরাময়ে এটি সবচেয়ে প্রচলিত ও কার্যকর পদ্ধতি। থেরাপিস্ট ধীরে ধীরে রোগীকে তাঁর ভয়ের উদ্রেককারী বস্তু বা পরিস্থিতির মুখোমুখি করান, যেমন সবজি দেখা, ছোঁয়া বা রান্না করা।
এমনটা করার কারণ হলো ধীরে ধীরে রোগীকে তাঁদের অযৌক্তিক ভয়ের প্রতি সংবেদনশীল করে তোলা। বাস্তবে রোগী যত বেশি ভয়ের ঘটনার মুখোমুখি হবেন, তত তাঁদের ভয় কেটে যাবে।
ডায়ালেকটিক্যাল বিহেভিয়ার থেরাপি বা ডিবিটি
এই থেরাপি মূলত আবেগ নিয়ন্ত্রণ শেখায়। এর মধ্যে ‘হাফ স্মাইলিং’নামে একটি কৌশল আছে, যেখানে ভয় সম্পর্কে চিন্তা করার সময় হালকা হাসি দিয়ে মনের প্রতিক্রিয়া বদলানো হয়। এটি মানসিক যন্ত্রণার তীব্রতা কমায়।
মাইন্ডফুলনেস ও মেডিটেশন
ডিবিটির অংশ হিসেবে মাইন্ডফুলনেস বা সচেতন ধ্যান মানসিক স্থিরতা আনে। নিয়মিত ধ্যান ও শ্বাসপ্রশ্বাসের অনুশীলন উদ্বেগ নিয়ন্ত্রণে রাখে, মনোযোগ বাড়ায় এবং প্যানিক অ্যাটাকের সময় রোগীকে শান্ত হতে সাহায্য করে।
কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি বা সিবিটি
এটি এমন একটি মনঃসামাজিক চিকিৎসা, যেখানে রোগীকে তাঁর চিন্তা ও আচরণের ধরন বিশ্লেষণ করে শেখানো হয়—কীভাবে সেসব চিন্তা তাঁর ভয় ও প্রতিক্রিয়াকে প্রভাবিত করছে। এ ধরনের থেরাপির লক্ষ্য হলো নেতিবাচক চিন্তার ধারা ভেঙে ফেলা।
ব্যায়াম
শারীরিক অনুশীলন উদ্বেগ ও মানসিক চাপ কমাতে অত্যন্ত কার্যকর। হাঁটা, দৌড়, সাঁতার, সাইক্লিং বা খেলাধুলা শরীরে সেরোটোনিন বাড়ায়, যা মানসিক প্রশান্তি আনে। তবে যাঁরা ল্যাকানোফোবিয়ার কারণে অপুষ্টিতে ভুগছেন, তাঁরা ব্যায়াম শুরুর আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন।
শেষ কথা
ল্যাকানোফোবিয়া বা সবজির প্রতি ভয় কোনো নিরাময়হীন সমস্যা নয়। সঠিক থেরাপি, ধৈর্য ও মানসিক সমর্থনের মাধ্যমে এই ভয় জয় করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রথমেই পদক্ষেপ নেওয়া, অর্থাৎ মানসিক স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলা। ভয়ের মূল কারণ বুঝে চিকিৎসা নিতে পারলেই সুস্থ জীবনের পথে ফিরে আসা সম্ভব।
সূত্র: ই-কাউন্সেলিং