‘বছরের শুরুতেও কল্পনা করতে পারিনি, এত কিছু হয়ে যাবে’
নওশাদ ফেরদৌসকে চেনেন? ২০২৩ সালে নানা কারণেই সংবাদমাধ্যমগুলোয় উঠে এসেছে তাঁর নাম। কীভাবে একটা বছরেই একজন মানুষের জীবনের মোড় ঘুরে যেতে পারে, তার একটা উজ্জ্বল উদাহরণ হতে পারেন নওশাদ। চলুন, নতুন বছরের প্রথম সপ্তাহে তাঁর গল্প থেকেই অনুপ্রাণিত হওয়া যাক।
সংস্কৃতিমনা একটা পরিবারে বড় হয়েছিলেন নওশাদ। বড় ভাই নজরুল সংগীতশিল্পী। বোনেরাও গানচর্চা করতেন। সবাই যদি একই কাজ করে, কী করে হবে! আগ্রহ থাকলেও তাই গানের সঙ্গে থাকা হয়নি নওশাদের।
যেভাবে কোরিয়ান গানের প্রতি ঝোঁক
২০১৬ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় পাড়ি জমান নওশাদ। সেখানকার একটা গাড়ির যন্ত্রাংশ উৎপাদনকারী কোম্পানিতে শুরু হয় কর্মজীবন। পাশাপাশি কোরিয়ায় বসবাসরত বিদেশিদের সহায়তা কেন্দ্র, ফরেন সাপোর্ট সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত হন। একদিন সেই সেন্টারে বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠান হবে বলে ঠিক হয়। কিন্তু বাংলাদেশের কাউকেই পাওয়া যাচ্ছিল না। নওশাদের মনে হলো, বাংলাদেশের কেউ না থাকলে বাংলাদেশকে কেউ চিনবে না। যে করেই হোক, দেশের প্রতিনিধিত্ব তো করতে হবে। সেবার সেই অনুষ্ঠানে একটি কোরীয় গান গেয়েছিলেন তিনি।
অনুষ্ঠান শেষে আর সবার সঙ্গে নওশাদকেও দেওয়া হয়েছিল পুরস্কার। কিন্তু তাতে তাঁর ঠিক মন ভরেনি। একটু সংকোচও হচ্ছিল। খুব যে ভালো গেয়েছেন, তা তো নয়। এমন ‘সান্ত্বনা পুরস্কার’ তিনি চাননি।
সে সময়ই ঠিক করেছিলেন, পুরোদস্তুর প্রস্তুত হয়েই এরপর মঞ্চে উঠবেন। ২০২৩ সালে কোরিয়ারই একটি বড় ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়ে যান গান শেখার জন্য। একসঙ্গে দুই ওস্তাদের কাছে তালিম নিতেন তিনি। একজন পুরোনো দিনের নামকরা শিল্পী, অন্যজন হাল আমলের। দুজনের শেখানোর ধরনও তাই আলাদা। এই বৈচিত্র্যকেই কাজে লাগালেন নওশাদ। দুই ওস্তাদের শেখানোর পদ্ধতি ও কৌশল নিজের মতো করে রপ্ত করেন তিনি। গান শেখার এই পাঠশালা থেকেই ৪৪তম ন্যাশনাল ওয়ার্কার্স ফেস্টিভ্যালের খবর পান।
নওশাদে মুগ্ধ বিচারকেরা
ন্যাশনাল ওয়ার্কার্স ফেস্টিভ্যাল মূলত দক্ষিণ কোরিয়ায় কর্মরত দেশি-বিদেশি কর্মজীবী বা পেশাজীবীদের একটি প্রতিযোগিতা। ২০২৩ সালের ১৩ এপ্রিল মূল পর্বে নওশাদ পরিবেশন করেন একটি জনপ্রিয় কোরিয়ান গান। বাংলায় গানটির শিরোনাম অনেকটা এমন—একজন পুরুষের কথা। গান শুনে বিচারক বলেন, ‘আমরা সত্যিই অবাক। একজন বিদেশি হয়ে কীভাবে তুমি এত নিখুঁতভাবে গাইলে, এত নিখুঁত আবেগ ঢেলে দিলে। আমাদের আসলে বলার কোনো ভাষা নেই।’ তখন একটু আশা জেগেছিল নওশাদের মনে। কিন্তু সবাইকে ছাড়িয়ে যে চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাবেন, ভাবেননি। চ্যাম্পিয়ন হিসেবে তিনি পান ক্রেস্ট, সনদ ও ৫০ লাখ কোরিয়ান উওন (বাংলাদেশের হিসাবে প্রায় ৪ লাখ টাকা)।
অন্য রকম বছর
২০২৩ সালটা নিশ্চয়ই নওশাদের কাছে বিশেষ হয়ে থাকবে। এই এক প্রতিযোগিতাই ঘুরিয়ে দিয়েছে তাঁর জীবনের মোড়। মুঠোফোনে নওশাদ বলেন, ‘প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে কোরিয়ানদের কোনো প্রতিযোগিতায় প্রধানমন্ত্রীর পুরস্কার পাওয়া আমার জন্য অনেক বড় ব্যাপার। বছরের শুরুতে কল্পনাও করতে পারিনি এত কিছু হয়ে যাবে। তিন বছরের লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছিলাম। কিন্তু এই পুরস্কার আমাকে অল্পতেই সেই সুযোগ করে দিল। আমি বুঝতে পারি, কোরিয়ানদের কাছে আমার পুরস্কারের গুরুত্ব অনেক। আমি যেন সামনে ভালো করতে পারি, এ জন্য তাঁরাই সহায়তা করছেন। তিনজন গানের শিক্ষক নিজে থেকে এখন আমাকে তালিম দিচ্ছেন।’
জানালেন, সেই প্রতিযোগিতার পর কোরিয়াতে আরও বেশ কিছু প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন, পুরস্কার পেয়েছেন এই প্রবাসী। তিনি বলেন, ‘একেকটি প্রতিযোগিতা কোরিয়ার একেক প্রান্তে হওয়ায় এ সময় বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেয়েছি। কোরিয়ার প্রথম সারির টিভি, পত্রিকা আমাকে নিয়ে প্রতিবেদন করেছে। এ ছাড়া, কোরিয়ার স্বনামধন্য টিভি কেবিএস (কোরিয়ান ব্রডকাস্টিং সিস্টেম) আমাকে নিয়ে ১৬ মিনিটের একটি তথ্যচিত্র বানিয়েছে, যা জাতীয়ভাবে প্রচারিত হয়। কোরিয়ার শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে ২ রাত ৩ দিনের জন্য তাইওয়ান ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছি। প্রথমবারের মতো কোনো বিদেশি এই সুযোগ পেল।’
২০২৩ তাঁকে দুই হাত ভরে দিয়েছে। তাই দারুণ উদ্যম নিয়ে ২০২৪–এ পা রেখেছেন নওশাদ ফেরদৌস। নতুন এই বছর আরও কী কী চমক রেখেছে, কে জানে!