স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জে যেভাবে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ
‘আমি যখন কলেজে পড়ি, তখন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা টিমের খবর চোখে পড়েছিল। নাসা ইন্টারন্যাশনাল স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল তারা। সে সময় দলটা নাসায় যাওয়ার সুযোগও পেয়েছিল। কিন্তু ভিসা জটিলতায় তাদের যাওয়া হয়নি। ২০১৮ সালে ওই খবর দেখার পর থেকেই মূলত আমারও স্বপ্ন দেখার শুরু,’ বলছিলেন মো. খালিদ সাকিব। এ বছর তাঁরই নেতৃত্বে বাংলাদেশের একটি দল সেই একই প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।
প্রতিবছরই ‘নাসা আন্তর্জাতিক স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জ’ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা-নাসা। এ বছর প্রতিযোগিতায় ১৫২টি দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা অংশ নিয়েছিল। সেখানেই বেস্ট স্টোরিটেলিং বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে রাজশাহীর বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘টিম ভয়েজার্স’। মো. খালিদ সাকিব সেই দলেরই দলনেতা। মোট সদস্য পাঁচজন। একেকজনের ছিল একেক দায়িত্ব। মো. সাখাওয়াত হোসেন যেমন ইউআই বা ইউএক্স ডিজাইনের বিষয়টি দেখেছেন। আবদুল মালেক ছিলেন অ্যাপ তৈরির দায়িত্বে। মো. আতিক লেভেল ডিজাইনার হিসেবে কাজ করেছেন। ফাহমিদা আক্তার ছিলেন গবেষক। আর দলনেতা মো. খালিদ সাকিব করেছেন ভিডিও সম্পাদনা ও চিত্রনাট্যের কাজ।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঠার পর থেকেই নাসার এই সম্মানজনক প্রতিযোগিতা সম্পর্কে খোঁজখবর করছিলেন সাকিব। কিন্তু ভর্তির পরপরই যেহেতু করোনা মহামারির আঘাত এল, তাই শুরুর দিকে তিনি কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। পরে জানতে পারেন, প্রতিযোগিতার বাংলাদেশ পর্বের আয়োজক বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস)। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ‘বেসিস স্টুডেন্ট ফোরাম’ নামের সংগঠন এই প্রতিযোগিতা–সংক্রান্ত নানা ধরনের কাজ করে। কিন্তু বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন বেসিস স্টুডেন্ট ফোরাম ছিল না। ২০২২ সালে সাকিব নিজ উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠা করেন বেসিস স্টুডেন্ট ফোরাম, বরেন্দ্র ইউনিভার্সিটি চ্যাপটার। সে বছরই প্রথমবারের মতো প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন তিনি। দলের নাম ছিল ‘টিম ক্রিপ্টোনাইট’। ২০২২ সালে গ্লোবাল নমিনেশন না পেলেও রাজশাহী অঞ্চল থেকে সেকেন্ড রানার্সআপ হয় ‘টিম ক্রিপ্টোনাইট’। নাসা ইন্টারন্যাশনাল স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জ ২০২৩ সালে ‘টিম ভয়েজার্স’ নামে আবার অংশগ্রহণ করে দলটি।
খালিদ সাকিব বলেন, ‘২০২৩ সালে আমি ক্লাবের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নিয়ে শিক্ষার্থীদের এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে শুরু করি। প্রথম দিকে ১০টি দলকে প্রশিক্ষণও দিয়েছি। আগে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি দল অংশগ্রহণ করেছিল। আর এবার করেছে তিনটা। কিন্তু সবাইকে প্রশিক্ষণ দিতে গিয়ে আমি আমার নিজের দলকেই সময় দিতে পারিনি। ফলে আমরা সেরা ৫০ দলের মধ্যে ছিলাম না। যে কারণে ভার্চ্যুয়ালি আমাদের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে হয়েছে।’
প্রতিযোগিতাটির জন্য সারা বাংলাদেশকে নয়টি অঞ্চলে ভাগ করা হয়। একেকটি অঞ্চল থেকে তিনটি করে দল জয়ী হলেও বাংলাদেশ থেকে গ্লোবাল নমিনেশন পায় ‘টিম ভয়েজার্স’সহ মোট ১৩টি দল। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের ৩টিসহ মোট ৪০টি দলকে গ্লোবাল ফাইনালিস্ট হিসেবে বাছাই করা হয়।
এবারের প্রতিযোগিতায় নাসা থেকে মোট ৩০টি চ্যালেঞ্জ দেওয়া হয়েছিল। চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে ‘টিম ভয়েজার্স’ বাছাই করে ‘এভরিথিং স্টার্টস উইথ ওয়াটার’। চ্যালেঞ্জের মূল বিষয়—পানি। পৃথিবীতে মোট ৩৭০ কোয়ান্টিলিয়ন (১ এর পর ১৮টি ০) গ্যালন পানি আছে। এর মাত্র শূন্য দশমিক শূন্য ১ শতাংশ বিশুদ্ধ পানি। অথচ এই মহামূল্যবান সম্পদ আমরা প্রতিনিয়ত অপচয় করছি। সারা পৃথিবীতে পানি কীভাবে প্রবাহিত হচ্ছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনে এটি কীভাবে ভূমিকা রাখছে, সেটি সবাইকে সহজভাবে বোঝানোই ছিল চ্যালেঞ্জের মূল প্রতিপাদ্য। টিম ভয়েজার্স এই চ্যালেঞ্জের জন্য তাদের প্রকল্পের নাম দেয় ‘অ্যাকুয়া এক্সপ্লোরার’।
প্রতিযোগিতাটি শুধু যে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য, তা নয়। বরং এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। প্রকল্পের ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে মো. খালিদ সাকিব বলেন, ‘সম্পূর্ণ প্রকল্পটি ডেভেলপ করতে আরও অনেক সময় ও গবেষণার প্রয়োজন। আমার দলের সবাই এখনো শিক্ষার্থী। কেউ কেউ খণ্ডকালীন চাকরি করে। তাই জলবায়ু নিয়ে কাজ করে, এমন কোনো স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান বা সফটওয়্যার কোম্পানি এগিয়ে এলে আমরা প্রকল্পের সবকিছু বুঝিয়ে দিতে চাই।’
জানিয়ে রাখি, ২০১৮ সালে নাসা ইন্টারন্যাশনাল স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জ প্রতিযোগিতায় ‘বেস্ট ইউজ অব ডেটা’ বিভাগে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দল ‘টিম অলীক’। ২০২১ সালে ‘বেস্ট মিশন কনসেপ্ট’ বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয় খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) এবং বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে গড়া দল ‘টিম মহাকাশ’। ২০২২ সালে ‘মোস্ট ইন্সপিরেশনাল’ বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ‘টিম ডায়মন্ডস’। বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হাত ধরে এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকল।