সন্তান হিসেবে আমাদের অস্বীকার করছেন বিদেশ ফেরত বাবা

আইনি নানা সমস্যা নিয়ে এই বিভাগে আপনিও পাঠাতে পারেন প্রশ্ন। নির্বাচিত একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মিতি সানজানা

মিতি সানজানা

প্রশ্ন: আমার মা ও বাবার বিয়ে হয়েছে প্রায় ২২ বছর। বিয়ের পর বাবা বিদেশে চলে যান। তিন বছর পরপর দেশে এসে তিন মাস থেকে আবার চলে যেতেন। প্রতিবার দেশে এসে মায়ের গায়ে হাত তুলতেন। বিদেশ থেকে মাসে ২০ হাজার করে টাকা পাঠাতেন। ২০২৩ সালে একেবারে দেশে চলে আসেন বাবা। এর পর থেকে আমাদের খরচ দেওয়া বন্ধ করে দেন। প্রতিদিন মায়ের সঙ্গে বিনা কারণে ঝগড়া করেন, অশ্রাব্য গালিগালাজ করেন, গায়ে হাত তোলেন, বিচ্ছেদ চান। সন্তান হিসেবে আমাকে আর আমার ভাইকেও অস্বীকার করেন। মাকে মারার প্রতিবাদ করায় ভাইকে চাকু মারতে গিয়েছিলেন, তখন সে বাবার গায়ে হাত তোলে। প্রতিদিন তাঁর এই ব্যবহারের কারণে আমি ও আমার ভাই তাঁর সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছি। মা তাঁর সব অত্যাচার সহ্য করেন। কারণ, তিনি চান না বাবা আমাদের ছেড়ে চলে যান। তাহলে মানুষ আমাদের খারাপ চোখে দেখবে। বাবা এখন মা ও ভাইয়ের নামে মামলা করতে চান। এ অবস্থায় কী করব?

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক

উত্তর: পারিবারিক সহিংসতা বলতে পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে, এমন কোনো ব্যক্তি কর্তৃক পরিবারের অপর কোনো নারী বা শিশু সদস্যের ওপর শারীরিক, মানসিক বা যৌন নির্যাতন অথবা আর্থিক ক্ষতিকে বোঝাবে। জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ, ১৯৭৯ ও শিশু অধিকার সনদ, ১৯৮৯-এ স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র হিসেবে এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে বর্ণিত নারী ও শিশুর সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার নিমিত্ত পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ,পারিবারিক সহিংসতা হতে নারী ও শিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০ প্রণীত হয়েছে। আপনাদের বাড়িতে যেটা ঘটছে, সেটা পারিবারিক সহিংসতা।

পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০-এ প্রথমবারের মতো পারিবারিক সহিংসতাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) বিধিমালা প্রণীত হয়েছে। একজন শিশু বা নারী যিনি পারিবারিক সম্পর্ক থাকার কারণে পরিবারের অপর কোনো সদস্য কর্তৃক সহিংসতার শিকার হয়েছেন বা হচ্ছেন বা সহিংসতার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন, দেশের আইন অনুযায়ী তিনি প্রতিকার চাইতে পারবেন। আপনার বাবা আপনার মায়ের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করছেন। সেই সঙ্গে আপনারা আর্থিক বৈষম্যের শিকার। আপনার বাবার এ ধরনের আচরণ পারিবারিক সহিংসতার অন্তর্ভুক্ত। আইনের অধীনে আপনার মা নিম্নলিখিত প্রতিকারগুলো চাইতে পারবেন—

ক. এই আইন অনুসারে প্রতিকার পাওয়ার অধিকার

খ. চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তির সুযোগ

গ. প্রয়োগকারী কর্মকর্তার কাছ থেকে সেবা পাওয়ার সুযোগ

ঘ. প্রযোজ্য ক্ষেত্রে, আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০ অনুসারে বিনা খরচে আইনগত পরামর্শ ও সহায়তা বা অন্য কোনো আইন অনুসারে প্রতিকার পাওয়ার উপায়

আরও পড়ুন

আদালতে আবেদন

আপনার মায়ের পক্ষে কোনো প্রয়োগকারী কর্মকর্তা, সেবা প্রদানকারী বা অন্য কোনো ব্যক্তি এই আইনের অধীন প্রতিকার পাওয়ার জন্য আবেদন করতে পারবেন। আবেদনপ্রাপ্তির সাত দিনের মধ্যে আদালত আবেদন শুনানির জন্য তারিখ নির্ধারণ করবেন।

পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০-এর অধীনে একজন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি নিম্নবর্ণিত প্রতিকার পেতে পারেন—

১. অন্তর্বর্তীকালীন সুরক্ষা আদেশ: অন্তর্বর্তীকালীন সুরক্ষা আদেশ বিষয়ে আইনের ১৩ ধারায় বলা হয়েছে। আদালত সন্তুষ্ট হলে প্রতিপক্ষ বা তার প্ররোচনায় পারিবারিক সহিংসতা ঘটলে বা ঘটার আশঙ্কা থাকলে আদালত প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে একতরফাভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সুরক্ষা আদেশ প্রদান করতে পারবেন।

২. সুরক্ষা আদেশ: সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি ও প্রতিপক্ষকে শুনানির সুযোগ প্রদান করে আদালত যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে পারিবারিক সহিংসতা ঘটেছে বা ঘটার আশঙ্কা আছে, তাহলে সুরক্ষা আদেশ প্রদান করতে পারবেন। সেই সঙ্গে প্রতিপক্ষকে পারিবারিক সহিংসতামূলক কোনো কাজ সংঘটন, সংঘটনে সহায়তা করা, প্ররোচিত করা বা সুরক্ষা আদেশে উল্লিখিত অন্য যেকোনো কাজ করা থেকে বিরত থাকার আদেশ দিতে পারবেন।

৩. বসবাস আদেশ: এই আইনের ১৫ ধারায় বসবাসের আদেশ নিয়েও বলা আছে। সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত  বসবাস আদেশ প্রদান করতে পারবেন। এই আদেশের আওতায় সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি যেখানে বসবাস করেন, সেখানে প্রতিপক্ষের বসবাস বা যাতায়াত করার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ, সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিকে বাসার কোনো অংশ থেকে বেদখল করা বা ভোগদখলে কোনোরূপ বাধা সৃষ্টি করা থেকে বিরত করা ইত্যাদি পড়ে। আদালত যদি মনে করেন, সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা তাঁর সন্তানের জন্য বর্তমান আশ্রয়স্থল নিরাপদ নয়, তাহলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির সম্মতি সাপেক্ষে আদালত প্রয়োগকারী কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থানের ব্যবস্থা করবেন। তা ছাড়া প্রতিপক্ষকে জামানতসহ বা জামানত ছাড়া মুচলেকা সম্পাদনের আদেশ দিতে পারবেন, যেন তিনি বা তাঁর পরিবারের অন্য কোনো সদস্য ভবিষ্যতে পারিবারিক সহিংসতামূলক কাজ না করেন।

৪. ক্ষতিপূরণ আদেশ: আইনের ১৬ ধারায় ক্ষতিপূরণের আদেশের কথা বলা হয়েছে। আদালত সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি এবং তাঁর সন্তানের ভরণপোষণের জন্য তিনি যে ধরনের জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত, সে রকম জীবনযাত্রার জন্য পর্যাপ্ত ও যুক্তিযুক্ত অর্থ প্রদানের জন্য প্রতিপক্ষকে আদেশ দিতে পারবেন। তা ছাড়া উপযুক্ত মনে করলে আদালত এককালীন বা মাসিক ভরণপোষণ পরিশোধের আদেশ দিতে পারবেন।

৫. নিরাপদ হেফাজত আদেশ: আদালত উক্ত আইনের অধীনে আবেদন বিবেচনার যেকোনো পর্যায়ে, আইনের ১৭ ধারা অনুযায়ী সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির সন্তানকে তাঁর নিকট অথবা তাঁর পক্ষে অন্য কোনো আবেদনকারীর জিম্মায় অস্থায়ীভাবে সাময়িক নিরাপদ হেফাজতে রাখার আদেশ দিতে পারবেন।

কাজেই আপনার মা চাইলে যেকোনো থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা বা সরাসরি আদালতের কাছে সুরক্ষার জন্য আবেদন করতে পারবেন।

এই আইনের অধীনে সংঘটিত অপরাধ আমলযোগ্য, জামিনযোগ্য ও আপসযোগ্য। এই আইনের ৩০ ধারায় শাস্তির বিধান সম্পর্কে বলা আছে। তবে আদালত চাইলে প্রতিপক্ষকে ধারা ৩০-এর অধীন শাস্তি না দিয়ে ৩১ ধারা অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিভিন্ন ধরনের সমাজকল্যাণমূলক কাজে সেবা প্রদানের জন্য আদেশ দিতে পারবেন এবং বিষয়টি তত্ত্বাবধানের জন্য যেকোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাকে দায়িত্ব প্রদান করতে পারবেন।

এই আইনে শাস্তির পাশাপাশি সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে। যার ফলে পুনরায় দুই পক্ষের মধ্যে আপস–নিষ্পত্তি করা সহজ হয়। তা ছাড়া দণ্ডবিধির ধারা ৩২৩-এ স্বেচ্ছাকৃতভাবে আঘাতদানের শাস্তির কথা বলা হয়েছে। এখানে বলা আছে, কেউ যদি স্বেচ্ছাকৃতভাবে আঘাত দান করেন, তার শাস্তি হবে এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা এক হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড। আপনারা চাইলে এসব আইনের অধীনে প্রতিকার চাইতে পারবেন।

আরও পড়ুন