‘মুখ না খুললে কেউ বুঝতে পারে না আমি বাংলাদেশি নই’

নেপালের মেয়ে স্তুতি রিমাল এমবিবিএস করতে এসেছিলেন বাংলাদেশে। ভর্তি হয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। এ বছর মে মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুষ্ঠিত চূড়ান্ত পেশাগত পরীক্ষায় সেরা দশে স্থান করে নিয়েছেন তিনি। কেমন ছিল তাঁর এই পথচলা? জানাচ্ছেন রাফিয়া আলম

এমবিবিএস চূড়ান্ত পেশাগত পরীক্ষায় দশম হয়েছেন নেপালের স্তুতি রিমাল
ছবি: স্তুতির সৌজন্যে

ভিন্ন দেশ, ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন সংস্কৃতি—ভিনদেশে পড়তে গেলে পড়ালেখার চাপ ছাড়াও সামনে আসে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ। চিকিৎসাবিদ্যার মতো বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করতে গেলে চ্যালেঞ্জটা আরও কঠিন। সব সামাল দিয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন অনুষ্ঠিত এমবিবিএস চূড়ান্ত পেশাগত পরীক্ষায় দশম হয়েছেন নেপালের স্তুতি রিমাল।

শুরুতে স্তুতি আর দশজন ভিনদেশি শিক্ষার্থীর মতোই ধাক্কা খেয়েছিলেন এ দেশে এসে। ক্লাসে চিকিৎসাবিদ্যার খুঁটিনাটি বোঝার আগেই তাঁকে ভাষাটা বুঝতে হয়েছে। সহপাঠী, বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা যখন ‘আইটেম’ (পরীক্ষা) নিয়ে চিন্তিত, স্তুতির চিন্তা ছিল ভাষা শেখা নিয়ে।

শুরুর গল্পটা

ছোটবেলা থেকে আঁকাআঁকি, আবৃত্তি আর সৃজনশীল লেখালেখির চর্চা ছিল স্তুতির। ভায়োলিন বাজানো আর নাচেও যুক্ত ছিলেন। ছিলেন স্কুল বাস্কেটবল দলের দলনেতা। তবে জীবনে কী করতে চান, এই ভাবনা যখন ভাবতেন, তখন মনে হতো এমন কিছু করবেন, যা মানুষের জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। সেই ভাবনা থেকেই এই সম্মানজনক পেশার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজগুলোয় রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। তাই শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি রোগীকে কাছ থেকে দেখতে পারেন, আরও বেশি শিখতে পারেন—এমন খবর পেয়েই এ দেশে পড়ার কথা ভেবেছিলেন স্তুতি। সার্কের বৃত্তিতে প্রতিবছর ১৯ জন নেপালি শিক্ষার্থী বাংলাদেশে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। এ সুযোগই নিয়েছিলেন তিনি।

ভাষা দেয়াল নয়, ভাষা ভালোবাসা

ভিনদেশ থেকে পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের যে ‘কমিউনিটি’, সেখান থেকে সব রকম সাহায্য পেয়েছেন স্তুতি। বাংলা জানা না থাকায় ক্লাসে যা বুঝতে অসুবিধা হতো, পরে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বুঝে নিতেন। অগ্রজেরাও বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সহযোগিতার হাত। অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে গেলেও ছোটাছুটি করে সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন তাঁরাই।

মেডিকেলের পড়া কেবল বই–খাতা আর ল্যাবরেটরির গণ্ডিতে আটকে থাকে না। যেতে হয় হাসপাতালের ওয়ার্ডে। রোগী দেখেই শিখতে হয় রোগ সম্পর্কে। স্তুতি নাকি ভাষাও অনেকখানি শিখেছেন রোগীদের কাছ থেকেই। চিকিৎসা নিতে আসা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিদেশি হিসেবে পেয়েছেন আলাদা সম্মান। এ ছাড়া মেডিকেল কলেজের বন্ধু, সহপাঠী, হলের কর্মচারীরা হয়ে উঠেছিলেন স্তুতির ‘বাংলা টিচার’।

এমবিবিএসের চূড়ান্ত পেশাগত পরীক্ষায় রোগীর সঙ্গে রোগীর ভাষায় কথা না বলে উপায় নেই। দক্ষতার সঙ্গে রোগীর কাছ থেকে তাঁর সমস্যা সম্পর্কে জেনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাটা এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেই কাজে স্তুতি যে সফল, প্রমাণ মেলে পরীক্ষার ফলাফলেই। আরও জানিয়ে রাখি, আমরা যখন এই সাক্ষাৎকারের জন্য স্তুতির সঙ্গে কথা বলছি, পুরো আলাপটা কিন্তু বাংলা ভাষাতেই হলো।

আরও পড়ুন

ভাষা ছাড়া আরও যা নতুন

কাঠমান্ডু থেকে ঢাকায় আসা স্তুতি শুরুতে গরম আবহাওয়ায় ভুগতেন বেশ। তিনি তো বেড়েই উঠেছেন পাহাড় আর মৌসুমি হাওয়ার দেশে। খাবারদাবার নিয়েও কিছুটা অসুবিধা হতো। পরে অবশ্য নিজেই রান্না শুরু করেন।

বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে চিনেছেন এ দেশে এসে। আসার আগে শুনেছিলেন, এ দেশের নারীদের পোশাকে রক্ষণশীলতা বাধ্যতামূলক। পরে বুঝেছেন, বাংলাদেশের মানুষ আদতে কট্টরপন্থী নন, বরং উদার। তাই তিনি সহজেই মিশে যেতে পেরেছেন। বললেন, ‘এমনও অনেক সময় হয় যে মুখ না খুললে কেউ বুঝতেই পারে না আমি বাংলাদেশি নই!’ ঢাকার বাইরেও ঘুরতে গেছেন কয়েকবার। দেখেছেন সিলেট, রংপুর। সমুদ্র দেখেছেন কক্সবাজার আর কুয়াকাটায়।

এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিক্ষানবিশ চিকিৎসক হিসেবে কাজ করছেন স্তুতি রিমাল। নেপাল থেকে এ দেশে এমবিবিএস পড়তে এলে শিক্ষানবিশি বাধ্যতামূলক। নিঃসন্দেহে এই অভিজ্ঞতাও হবে তাঁর ভবিষ্যতের পাথেয়। তবে একটা কষ্ট রয়ে গেল এখানেই। বাংলাদেশি শিক্ষানবিশ চিকিৎসকেরা সরকারিভাবে সম্মানী পান। বিদেশিরাও পেতেন ২০০৮ সাল পর্যন্ত। কিন্তু এরপর আর দেওয়া হয়নি। স্তুতি বলছিলেন, ‘সম্মানী পেলে আলাদা একটা অনুপ্রেরণা পেতাম।’

শিক্ষানবিশি শেষে স্তুতি ফিরে যাবেন নেপালে—মা, বাবা, দাদি আর বোনের কাছে। প্রস্তুতি নেবেন যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করার জন্য। ভবিষ্যতে নিউরোসার্জন হতে চান এই মেধাবী চিকিৎসক।