যে কাজ মায়ের জন্য সবচেয়ে কঠিন ছিল

আজ মা দিবসে মাকে নিয়ে লিখেছেন বিশ্ববিদ্যালয়–ভর্তি পরীক্ষার্থী আভেরী রহমান।

মা মাহমুদা রহমনের সঙ্গে আভেরী রহমান
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

সপ্তম শ্রেণির সমাজ বইয়ে মা-বাবা-ভাই-বোন নিয়ে যে ‘আদর্শ’ পরিবারের কথা পড়েছি, তেমনটা আমি কখনোই পাইনি। আমার কাছে পরিবার মানেই আমি আর আমার মা। বাকিদের চোখে এই পরিবার ‘আদর্শ’ না-ও মনে হতে পারে—এই ভেবে স্কুলে পড়ার সময় মা চাইত না, আমি আমার বন্ধুদের জানাই যে আমার বাবা আমাদের সঙ্গে থাকেন না। মা সম্ভবত ভয় পেত, আমার এই একান্ত ব্যক্তিগত তথ্যটির জন্য আমি বুলিংয়ের শিকার হব। বন্ধুদের অভিভাবকেরা হয়তো আমাকে ভিন্ন চোখে দেখবে, অথবা আর মিশতেই দেবে না।

মা নিজেও বিষয়টি নিয়ে বন্ধুদের মায়েদের সঙ্গে যেচে কথা বলত না। কিন্তু মায়েদের আড্ডায় ঠিকই এ প্রসঙ্গ একদিন উঠেছিল। বন্ধুর মায়েরা আমার মাকে জিজ্ঞাসা করতে লাগল বাবার কথা। বাবা কোথায় আছেন, তিনি দেশে কবে ফিরছেন? তার এ অতি উৎসাহী প্রশ্নের উত্তর দিতে মাকে কিছুটা সংকোচ করতে দেখেছি। আমার স্পষ্টভাষী মায়ের এই সংকোচবোধ আমাকে আবার মনে করিয়ে দিয়েছিল, একটা দীর্ঘ সময় মাকে লড়াই করতে হয়েছে নিজের সঙ্গে, পরিবারের সঙ্গে, আমার বাবার সঙ্গে। কিন্তু লড়াইটি কখনোই তার একার ছিল না। আমি বুঝতে পারলাম, এ লড়াই আমারও। তাই মায়ের হাত ধরে প্রথমবারের মতো আমিই উত্তরটা দিয়েছিলাম সেদিন, ‘মা-বাবা আর একসঙ্গে থাকেন না।’

মা-বাবার বিচ্ছেদের বিষয়টি আসলে আমাকেও প্রথমে জানানো হয়নি, জানতাম বাবা বিদেশে থাকে। কেননা, বুঝতে শেখার পর থেকে কখনোই বাবাকে কাছে পাইনি। যখন আমার বয়স আট কি নয়, তখন প্রথম জানতে পারি এবং বুঝতে শুরু করি যে আমার মা-বাবা একসঙ্গে থাকেন না। আমি কখনো কারণ জানতে চাইনি। শৈশবে মায়ের সঙ্গে খুব বেশি সময় কাটাতে পারিনি, তাই কথাও কম হতো। কী করেই বা হবে? সপ্তাহে ছয় দিন ঘুম থেকে উঠেই মাকে দেখতাম অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছেন, ফিরতেন সূর্য ডোবার পর। মায়ের এই ব্যস্ততাকে আমি কিছুতেই নিতে পারতাম না। খুব রাগ হতো। কিন্তু তাঁর ব্যস্ততা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমিও তো বড় হচ্ছিলাম। বুঝতে শুরু করছিলাম, এ সব-ই আমার জন্য। আমার পড়াশোনার খরচ, সব আবদার—সব মাকেই দেখতে হয়েছিল।

আরও পড়ুন

সমাজের নির্ধারণ করে দেওয়া ‘আদর্শ পরিবার’-এর সব যেন আমি পাই, সেটা মা-ই নিশ্চিত করেছিল। সপ্তাহের ছয় দিনের খামতি মা আমাকে এক দিন কাছে পেয়ে মিটিয়ে দিতেন। তাঁর এত পরিশ্রম বিফলে যায়নি। ন্যূনতম বেতনের কেরানি থেকে আমার মা মাহমুদা রহমান তার নিজের ‘ট্রাভেল এজেন্সি’ গড়ে তুলেছে। একজন স্বাধীনচেতা মানুষ, সিঙ্গেল মাদার, বিশেষ করে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হিসেবে মায়ের যাত্রাটা মোটেও সহজ ছিল না। কারণ, এটা সেই সময়ের কথা, যখন সমাজ একা মায়েদের খাটো চোখেই দেখত। সে রকম সময়ে তিনি একটি তিক্ত সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসার পাশাপাশি একলা সন্তানকে বড় করার মতো সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল।

একজন সফল উদ্যোক্তা এবং অসাধারণ মা হয়ে ওঠার পথে তাঁর যে কঠিন যাত্রা, সেই যাত্রার প্রতিটি মুহূর্ত আমি দেখেছি নিজ চোখে। শিখেছি, কীভাবে নিজের অধিকার নিজেকে আদায় করতে হয়। মা আমাকে তার মতো করেই নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে শিখিয়েছে।

‘আদর্শ পরিবারের’ বাবারা কেমন হন, আমার ঠিক জানা নেই। কিন্তু আমি জানি, আমার মা অভিভাবক হিসেবে কোনো দায়িত্ব নিতে কখনো পিছপা হয়নি। যখন ছোট ছিলাম, মায়ের আয়ও স্বল্প ছিল, তখনো সে আমার শখগুলো পূরণ করেছে নিজ সামর্থ্যের মধ্যে থেকে। এখন যখন তার সামর্থ্য বেড়েছে, তখনো সে আমার ছোট-বড় আবদারগুলো পূরণ করে যাচ্ছে। আমার এই স্বাধীনচেতা, আধুনিক মাকে দেখে আমি অবাক হই। আর তাই এক ছুটির দিনের অলস দুপুরে নেটফ্লিক্সে কোনো জমজমাট থ্রিলার সিনেমা দেখতে দেখতে আমরা যখন দুই কাপ চা নিয়ে বসি, আমি তাকে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন করি, ‘একা এত কিছু করা কি কঠিন ছিল না?’ সব সময় মা একটা উত্তরই দিয়েছে। ছোট্ট আমাকে রেখে কাজে যাওয়াই ছিল তার জন্য সবচেয়ে কঠিন!