এম এম কলেজ: নির্মল আড্ডা আর ঐতিহ্যের ক্যাম্পাস

যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন (এমএম) কলেজে নিয়মিতই জমে এমন নির্মল আড্ডা
ছবি: প্রথম আলো

আমরা যখন যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন (এমএম) কলেজে পা রাখি, তখন হেমন্তের মিষ্টি রোদে ঝলমল করছে ক্যাম্পাস। আবদুল হাই কলাভবনের সামনে বাঁধাই করা ছোট্ট লেকে চোখে পড়ল পদ্ম ফুল। লেকের পাড়েও আছে দৃষ্টিনন্দন ফুলের বাগান। পাশেই নির্মল আড্ডা জমিয়েছিলেন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা।

অন্য বিভাগের তুলনায় এই বিভাগের ছাত্র–ছাত্রীরা মাঠপর্যায়ে জরিপ ও গবেষণায় কিছুটা এগিয়ে। ২০২০ সালে বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও গবেষক খ. ম. রেজাউল করিমের নেতৃত্বে চতুর্থ বর্ষের একদল শিক্ষার্থী জরিপ করার জন্য গিয়েছিলেন যশোর সদর উপজেলার ছাতিয়ানতলা গ্রামে। দিনব্যাপী শিক্ষার্থীরা সেখানে হাতে–কলমে গবেষণা শেখার উদ্দেশ্যে জরিপকাজ পরিচালনা করেন। জরিপ শেষে শিক্ষার্থীরা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন বিভাগের শিক্ষকদের কাছে। এরপর বিভিন্ন সময়ে যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র, সদর উপজেলার হামিদপুরসহ বিভিন্ন গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়েছে শিক্ষার্থীদের। গ্রামের মানুষের পেশা, তাঁদের অর্থনীতি ও সমাজ—এমন নানা বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছেন শিক্ষার্থীরা। এসব গ্রামের সামাজিক অর্থনীতি নিয়ে শিক্ষার্থীদের গবেষণাপত্রও আছে।

গবেষক খ. ম. রেজাউল করিম বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের পর্যবেক্ষণদক্ষতা বাড়ানো এবং জরিপ ও গবেষণা হাতে–কলমে শেখানোর জন্য তাদের বিভিন্ন গ্রাম ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানে নেওয়া হয়। পরে ওই বিষয়ে প্রতিবেদন উপস্থাপন করতে বলা হয়। এসব কাজের মধ্য দিয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসছে বলে আমি মনে করি।’

হামিদপুর গ্রামে গবেষণা করতে গিয়েছিলেন এই শিক্ষার্থীরা
ছবি: সংগৃহীত

প্রাণবন্ত বাংলা বিভাগ

বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আকতার হোসেন নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কলেজ প্রাঙ্গণে প্রতি মাসে শিক্ষার্থীদের নিয়ে দুটি করে পাঠচক্র ও বই পর্যালোচনা কার্যক্রম পরিচালনা করেন।

সম্প্রতি প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের আটটি দলে ভাগ করে প্রতিটি দলকে অগ্নিবীণা, চোখের বালি, বিষের বাঁশীর মতো বেশ কয়েকটি বই দেওয়া হয়েছিল। বই পড়ে শিক্ষার্থীরা নিজেদের দলের মধ্যে মুক্ত আলোচনা করেছেন, প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। পরে সবার সামনে তা উপস্থাপন করেছেন। ফলে আটটি বই সম্পর্কেই সবার জানা হয়ে গেছে। এ ছাড়া দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের নিয়েও আলাদাভাবে মাসে দুটি করে পাঠচক্র অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

শুধু সমাজবিজ্ঞান আর বাংলা বিভাগই নয়; ইংরেজি, ইতিহাসসহ অন্যান্য বিভাগেও পাঠদানে বৈচিত্র্য এসেছে। সহশিক্ষা কার্যক্রম হিসেবে বিভাগে ক্লাব, কুইজ, বিতর্ক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের চর্চাও রয়েছে।

সেমিনারের প্রবন্ধ নিয়ে বই

২০২১ সালে অধ্যাপক মর্জিনা আক্তার কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৯টি বিভাগের প্রধানকে ১৯টি সেমিনার আয়োজনের তাগিদ দেন। এরপর ২০২২ সালে প্রতিটি বিভাগ সাড়ম্বরে সেমিনারের আয়োজন করে। সেমিনারে বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা প্রবন্ধের ওপরে আলোচনা-সমালোচনা করেন। পরে ১৯টি প্রবন্ধ নিয়ে বই প্রকাশ করে কলেজ কর্তৃপক্ষ। বইটি মোড়ক উন্মোচনের অপেক্ষায় আছে।

আরও পড়ুন

প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষার্থীকে নিয়ে দেশের অন্যতম বড় বিদ্যাপীঠ যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ। পাঠদান কৌশল, শিক্ষার্থীদের ভালো ফল আর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত এ কলেজের সুনাম আছে। কলেজ প্রাঙ্গণে তিনটি সাংস্কৃতিক সংগঠন সক্রিয় আছে—উচ্চারণ সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী যশোর এম এম কলেজ সংসদ এবং বিবর্তন যশোর এম এম কলেজ শাখা। সেখানে প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে দুপুর অবধি গান, নাটক ও আবৃত্তির অনুশীলন হয়।

যেভাবে নামকরণ

এ কলেজের বিভিন্ন বিভাগে অনেক গুণী শিক্ষক পাঠদান করেছেন। তাঁদের মধ্যে একুশে পদকপ্রাপ্ত অধ্যাপক শরীফ হোসেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাহিত্যিক অজিত ঘোষ, বাংলা সাহিত্যের ছন্দ অলংকারবিষয়ক বইয়ের লেখক অধ্যাপক আবদুল নইম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক এ আর জোয়ার্দার, কবি অধ্যাপক আজিজুল হক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক খন্দকার সিরাজুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সৈয়দ আকরাম হোসেনের নাম উল্লেখযোগ্য।

গুণী এই শিক্ষকদের সান্নিধ্য পেয়ে এ বিদ্যাপীঠ থেকেই পাস করে বেরিয়েছেন দেশের অনেক রাজনীতিক, শিক্ষক, কবি, সাহিত্যিকসহ খ্যাতিমানেরা। তাঁদের মধ্যে ভারতের প্রখ্যাত লেখক নিমাই ভট্টাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক মেজবাহ কামাল, গীতিকার মোহাম্মদ রফিকুজ্জামানসহ অনেকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।

২০১৯ সালে প্রকাশিত এম এম কলেজ ডিরেক্টরি সূত্রে জানা যায়, ৮২ বছর আগে কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজের অধ্যাপক মহিতোষ রায়চৌধুরীর উদ্যোগে ‘যশোর কলেজ’ নামে এ বিদ্যাপীঠ প্রতিষ্ঠিত হয়। মহিতোষ রায় চৌধুরী যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গঙ্গানন্দপুর গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। পরে তাঁর ছেলে সুনীতি রায়চৌধুরী কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষ থাকাকালে এ কলেজের উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই কলেজ ছিল মিত্রবাহিনীর ঘাঁটি। সে সময় কলেজের কার্যক্রম হাটবাড়িয়ার জমিদারের কাছারিবাড়িতে (ফায়ার সার্ভিস কার্যালয়ের পাশে) স্থানান্তরিত হয়। ১৯৪৬ সালে ক্ষিতিনাথ ঘোষ, নীলরতন ধর, আইনজীবী ওয়ালিউর রহমান, আবদুর রউফ, চারুচন্দ্র দত্ত ও রায়বাহাদুর কেশবলাল চৌধুরী যশোর কলেজকে ‘মাইকেল মধুসূদন কলেজ’ নাম দেন।

প্রতিবছর ২৬ হাজার নিয়মিত শিক্ষার্থী ও ১০ হাজার প্রাইভেট শিক্ষার্থী নিয়ে কলেজের একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়
ছবি: প্রথম আলো

কেমন চলছে পড়ালেখা

বর্তমানে এ কলেজে উচ্চশিক্ষার ১৯টি বিষয়সহ উচ্চমাধ্যমিক, ডিগ্রি পাস, স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ কোর্সে পাঠদান চলছে। প্রতিবছর ২৬ হাজার নিয়মিত শিক্ষার্থী ও ১০ হাজার প্রাইভেট শিক্ষার্থী নিয়ে কলেজের একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। শিক্ষার্থী পরিবহনের জন্য বিজয়, স্বাধীন ও মুক্তি নামে তিনটি বাস রয়েছে। শরীরচর্চা ও ক্রীড়াক্ষেত্রে এ কলেজের খেলোয়াড়েরা দেশব্যাপী প্রশংসা পেয়েছেন।

কলেজের অধ্যক্ষ মর্জিনা আক্তার বলেন, দেশের অন্যতম সেরা মাইকেল মধুসূদন কলেজ। এ কলেজের শিক্ষার্থীদের দক্ষ ও গুণগতমানসম্পন্ন স্মার্ট নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আমাদের নানামুখী পদক্ষেপ রয়েছে। শিক্ষার্থীদের পাঠদান আরও বেশি আনন্দদায়ক করার জন্য প্রতিটা শ্রেণিকক্ষ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ও আধুনিক করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণমূলক পাঠদানে শিক্ষকেরা বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি বাড়ানোর জন্য আগে থেকে তারিখ ঘোষণা না করে হঠাৎ করে ইনকোর্স পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। সহশিক্ষা কার্যক্রম বাড়ানোর ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।