‘মনে হচ্ছিল, জীবন আমাদের কোথায় এনে দাঁড় করাল’

আজ মা দিবসে মাকে নিয়ে লিখেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী রায়হানা মালিক

মায়ের সঙ্গে লেখক
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

‘তুমি বাসায় যাও, আমি কাল আসব’, মিনিটখানেক জড়িয়ে ধরে রাখার সময় আমার কানে ঠিক এ কথাই বলেছিল বাবা। ২০১৯ সালের ২৭ মার্চ। দিনটা তো আর দশটা দিনের মতোও হতে পারত! কিন্তু না, আগের রাতে বাবাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে জেনেও নিবন্ধনপত্র আনতে আমাকে কলেজ যেতে হলো। কারণ, চার দিন পর আমার এইচএসসি পরীক্ষা। কলেজ থেকে বাসায় ফিরে অনেক মানুষের জটলা দেখে মনটা ধক করে উঠল। হাজারো ভিড়ে আমার চোখ যেন একজনকেই খুঁজছিল। মা, আমার ‘মাজি’। হাতটা শক্ত করে ধরে মা বলল, ‘হাসপাতালে যাচ্ছি। সময় শেষ, ওরা লাইফ সাপোর্ট বন্ধ করে দিতে চাইছে!’ সবটা বুঝেও যেন কিছুই বুঝলাম না। শুধু বললাম, ‘আব্বুকে সুস্থ করে নিয়ে আসো, প্লিজ।’

আমার বাবা তার কথা রেখেছিল। সে আবার ফিরে এল ঠিকই, কিন্তু নিথর হয়ে। যে মানুষটা অনিদ্রায় ভুগত, সে-ই যেন চলে গেল শান্তির ঘুমে। আমার হঠাৎ মনে হলো, কেউ যেন উঁচু কোনো দালান থেকে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে। কান্না আর থামাতে পারলাম না।

এসব ঘটনার মধ্যে পাশে তাকিয়ে দেখলাম, চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে আমার মা। তার চোখে প্রিয় মানুষটিকে হারানোর তীব্র বেদনা স্পষ্ট, কিন্তু তারপরও সে পাহাড়ের মতো শক্ত। আমাদের সবাইকে অবাক করে একা হাতে সে সম্পূর্ণ পরিস্থিতি সামলেছে। হাসপাতালের সব কাজ সেরে, আমাদের দুই বোনকে আত্মীয়দের কাছে রেখে, মা আর সবাইকে নিয়ে দাদুবাড়ি চলে যান দাফনের জন্য। বাস্তবতার কাছে মানুষ কতটা অসহায়! সবাই গেল, অথচ পরীক্ষার জন্য আমি যেতে পারলাম না। আমি আর আমার আপুজি শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম। মনে হচ্ছিল, জীবন আমাদের কোথায় এনে দাঁড় করাল। সুন্দর পৃথিবীটা যেন কেড়ে নিল কেউ। দীর্ঘ তিন মাসের যুদ্ধ শেষে সেদিন আমরা ছিলাম পরাজিতের দলে।

সব আনুষ্ঠানিকতা সেরে সাত দিন পর বাসায় এল আম্মু। জীবনের সবচেয়ে লম্বা পথটা বোধ হয় সেদিনই তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে। দীর্ঘ ৪৪ বছরের চলার সাথিকে কবরে রেখে কে আর স্বাভাবিক থাকতে পারে! তারপরও তিনি স্বাভাবিক হয়েছেন। বুকে যন্ত্রণা নিয়েও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রতিনিয়ত নিজেকে আরও শক্ত করেছেন। বাবাকে হারানোর পর যেন এক নতুন মাকে পেয়েছি আমরা।

আরও পড়ুন

যে আগের চেয়েও বেশি শক্ত, আরও বেশি দায়িত্বশীল। আমার বাকি পরীক্ষাগুলোয় আমার সঙ্গে যাওয়া থেকে শুরু করে, নতুন নতুন শহরে আমাকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা দিতে নিয়ে যাওয়া, আমাকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া—সবই মা সামলেছে নিজের মতো করে। মায়ের হাত ধরে নতুন করে পথচলা শুরু হয় আমাদের দুই বোনের। সেই থেকে ধীরে ধীরে মিরপুরের ‘মিলি আপা’, অফিসের ‘মুনিরা ইসলাম’ হয়ে গেল আমাদের মা-বাবা উভয়ই। জীবনে কখনো ভেঙে পড়লে যে একটা মুখ চোখে ভাসে, সেটা আমার জীবনযোদ্ধা মায়ের চেহারা। গর্ব হয় তোমায় নিয়ে মা। বিশ্বের সব মাকে মা দিবসের শুভেচ্ছা, আর অনেক বেশি ভালোবাসা তোমার প্রতি—‘মাজি’।