বন্ধুদের দেওয়া বই পড়ে আসাদুজ্জামান যেভাবে সহকারী জজ হলেন

জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের ১৬তম নিয়োগ পরীক্ষায় সহকারী জজ হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন আসাদুজ্জামান
ছবি: সংগৃহীত

আসাদুজ্জামান নুর হতে চেয়েছিলেন প্রকৌশলী। মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনাও করেছেন। কিন্তু বাবার ইচ্ছে ছিল ভিন্ন। তিনি চাইতেন, ছেলে আইন নিয়ে পড়ুক। তাঁর ইচ্ছাই শেষ পর্যন্ত পূরণ হয়েছে। জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের ১৬তম নিয়োগ পরীক্ষায় সহকারী জজ হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন এই তরুণ। তাঁর এত দূর আসার পেছনে একটা সংগ্রামের গল্প আছে।

জমি বিক্রি করে পড়ালেখা

মাত্রই পঞ্চম শ্রেণির পাট চুকিয়েছেন আসাদুজ্জামান, তখন বাবা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এর ঠিক দুই বছর পর ২০১২ সালে তিনি মারা যান। কাপড় সেলাই করে সংসারের হাল ধরার চেষ্টা করেন মা। আসাদুজ্জামান বলছিলেন, পরিবারে উপার্জনক্ষম বলতে কেউ ছিল না৷ আত্মীয়-স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের সহায়তায় কোনো রকমে সংসার চলত। এর মধ্যেই পড়ালেখাটা চালিয়ে গেছেন তিনি। মাধ্যমিক পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ এবং উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ৪.৩৩ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন তিনি।

কিন্তু কোচিং, টিউশনের খরচ জোগানোর মতো আর্থিক সচ্ছলতা পরিবারের ছিল না। বাধ্য হয়ে গ্রামে যে অল্প জমিজমা ছিল, সেটাও বিক্রি করে দিতে হয়। আসাদুজ্জামান ঢাকায় পাড়ি জমান। শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির প্রস্তুতি। প্রথমবার কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই সুযোগ পাননি। পরেরবার আরেকটু গুছিয়ে প্রস্তুতি নিয়ে সুযোগ পান ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও ভূমি ব্যবস্থাপনা বিভাগে।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও ভূমি ব্যবস্থাপনা বিভাগে পড়েছেন আসাদুজ্জামান
ছবি: সংগৃহীত

কখনো বিক্রয়কর্মী, কখনো হোটেল–ব্যবস্থাপক

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরও অভাব পিছু ছাড়ছিল না। আসাদুজ্জামান বলেন, শহর থেকে দূরত্ব বেশি হওয়ায় টিউশনি করানো কঠিন ছিল। এ দিকে নিজে চলার মতো টাকাও নেই। এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে সেন্টার ফর জাকাত ম্যানেজমেন্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কথা জানতে পারেন। সেখান থেকে মাসিক তিন হাজার টাকা বৃত্তি পেতেন। করোনাকালে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, পরিবারের অবস্থা আরও নাজুক। আসাদুজ্জামান নিজ জেলা পঞ্চগড়ে চলে যান। পরিবারের খরচ জোগাতে কখনো বিক্রয়কর্মী, কখনো ওয়েডিং ফটোগ্রাফার, আবার কখনো আবাসিক হোটেলের ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করেন তিনি।

করোনার পর সব আবার একটু একটু করে প্রাণ ফিরে পেলেও আসাদুজ্জামানের দুর্ভোগ তখনো কাটেনি। সাহায্যের আশায় বিভিন্ন জায়গায় ঘুরছিলেন, কোথাও ঠাঁই হচ্ছিল না। আসাদুজ্জামান সেই সময়ের স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘তত দিনে বুঝতে পেরেছি, জীবনে বড় কিছু করতে হলে পড়ালেখা করতেই হবে। তাই স্নাতকের বাকি সময়টা শুধু পড়াশোনার মধ্যে থাকব বলে স্থির করলাম। আর এ জন্য প্রয়োজন ছিল আর্থিক নিশ্চয়তা। চতুর্থ বর্ষে ওঠার পর সেটার ব্যবস্থা হলো। “পে ইট ফরওয়ার্ড বাংলাদেশ” নামে একটি ফেসবুক গ্রুপের সন্ধান পেলাম। ওখান থেকে মাসে ৩ হাজার টাকা বৃত্তি পেতাম।’

তিন হাজার টাকায় লেখাপড়া, নিজের খরচ, সবই সামলাতে হতো। বই কেনা আসাদুজ্জামানের জন্য বিলাসিতা ছিল। সেই দুঃসময়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন হলের বন্ধুরা। আসাদুজ্জামান বলেন, ‘পাশের রুমেই বিভাগের কয়েকজন বন্ধু থাকত। তারা আমার অবস্থা জানত, বিভিন্নভাবে সাহায্য করত। আমাকে নতুন করে বই কিনতে দিত না। বিভাগের এবং বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের সব বই তাদের কাছ থেকে নিয়েই পড়েছি।’

আরও পড়ুন

৪০তম হয়ে সহকারী জজ

পথচলাটা কখনোই সহজ ছিল না। তবে প্রতিকূলতাকে জয় করার স্পৃহা ছিল। সেই একাগ্রতার জোরেই অবশেষে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের ১৬তম নিয়োগ পরীক্ষায় ৪০তম হয়ে সহকারী জজ হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘এটা আমার চাকরির প্রথম পরীক্ষা। তাই খুশিটা আরও বেশি। বিচারকের আসন এমন একটা স্থান, যেখানে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। একই সঙ্গে এটি ইবাদতের একটি মাধ্যম। হাদিসে আছে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলার আরশের নিচে যেই সাত শ্রেণির ব্যক্তি ছায়া পাবেন, তার মধ্যে একজন হলো ন্যায়পরায়ণ বিচারক বা শাসক। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমি সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই।’