উড়োজাহাজে তীব্র ঝাঁকুনিতে মনে হচ্ছিল, আর বুঝি দেশে ফেরা হবে না

উড্ডয়নের আগে স্কুট এয়ারলাইনসে উড়োজাহাজে লেখক (ডানে)
ছবি: লেখক

গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকেই মন বেশ বিমর্ষ হয়ে আছে। কোনোভাবেই স্বাভাবিক হতে পারছি না। ঘুরে–ফিরে শুধু ভারতের আহমেদাবাদের উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার কথাই মনে পড়ছে। বারবারই মনে হচ্ছে, ১০ জুন এমন একটি ঘটনা আমাদের উড়োজাহাজে হতে যাচ্ছিল। সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা এখনো মন থেকে সরাতে পারিনি।

ইন্দোনেশিয়াতে আট দিনের লম্বা ট্রিপ শেষ করে আমরা ঢাকায় ফিরব। এ ভ্রমণে আমার সঙ্গী ছিলেন আরও সাতজন। প্রথমেই স্কুট এয়ারলাইনসে করে সিঙ্গাপুর যাব। সেখানে সাত ঘণ্টা ট্রানজিট, এরপর সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসে ঢাকায় ফিরব। সকাল ১০টা ৫০–এ ছিল আমাদের ফ্লাইট।

ভোরবেলা হোটেলে চেকআউট করে লাগেজ গাড়িতে তুলছি, তখন মেইল এল, আবহাওয়া বেশ খারাপ। যে কারণে ফ্লাইট ৪০ মিনিট ডিলে হবে! একটু সময় নিয়েই রওনা হলাম এয়ারপোর্টের উদ্দ‍েশে।

আরও পড়ুন

এয়ারপোর্টের যাবতীয় ফর্মালিটিস সেরে বোর্ডিংয়ে বসে আছি। যেহেতু লম্বা ট্রিপ, সবাই মোটামুটি ক্লান্ত! অপেক্ষা বিমানে ওঠার। ইন্দোনেশিয়ার সময় বেলা সাড়ে ১১টায় উড্ডয়ন করে স্কুট এয়ারলাইনসের উড়োজাহাজটি। সিটে বসেই আমরা ঘুমিয়ে যাই।

উড্ডয়নের ১০ থেকে ১৫ মিনিট পরে উড়োজাহাজটি ব্যাপক ঝাঁকুনি দেয়। যেহেতু উড়োজাহাজটি আকাশে ছিল, তাই অনেকেই সিটবেল্ট খুলে ফেলেছিলেন। তীব্র ঝাঁকুনিতে একজন আরেকজনের গায়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। কোনো সিটবেল্ট সাইনও ছিল না। অনেকটা হঠাৎ করেই ঘটনাটা ঘটল। তীব্র ঝাঁকুনি চলছেই, কেবিন ক্রুরা উঠে যে অ্যানাউন্সমেন্ট দেবেন, সেই অবস্থাও নেই। ততক্ষণে আমাদের অবস্থা নাজেহাল। বেশ খানিকক্ষণ স্থায়ী হলো প্রথম ঝাঁকুনি।

আমি দোয়া পড়তে শুরু করলাম, সৃষ্টিকর্তার কাছে মাফ চাইলাম। আশপাশে অন্য যাত্রীরাও যাঁর যাঁর মতো প্রার্থনা করছিলেন। আমার পাশের সিটের আপুর মোবাইলে আয়াতুল কুরসি দোয়াটা ছিল। তাঁকে বললাম বের করতে। তাড়াহুড়ো করে খুঁজে না পেয়ে যেটা পেয়েছি, সেটাই পড়লাম।

খানিকক্ষণ পর পেছনে তাকিয়ে দেখি, সব যাত্রীই নার্ভাস হয়ে গেছেন। চোখে–মুখে মৃত্যুর আতঙ্ক! সেই মুহূর্তে আমাদের মনের মধ্যে যে কী চলছিল, বলে বোঝাতে পারব না। বাংলাদেশি যাত্রী খুব বেশি ছিল না ওই ফ্লাইটে।

এর মধ্যে ঝাঁকুনি কিছুটা কমলে কেবিন ক্রুরা গিয়ে সিটবেল্ট বাঁধার কথা বললেন এবং যেন সবাই শান্ত থাকেন, সেই ঘোষণাও দিলেন। সঙ্গে জানালেন, আবহাওয়া খারাপ হওয়ার কারণে কিছুটা ডিফিকাল্টিজ ফেস করতে হচ্ছে।

তখন মনে হচ্ছিল, আর বোধ হয় দেশে ফেরা হবে না! হয়তো আর কারও সঙ্গে দেখা হবে না কোনো দিন। প্রায় আড়াই ঘণ্টা সময় কাটল এই আতঙ্ক নিয়ে। কারণ, অল্প সময় বিরতি দিয়ে পুরো যাত্রার সময় ঝাঁকুনি দিচ্ছিল উড়োজাহাজটি।

যখন অ্যানাউন্সমেন্ট হলো যে কিছু সময়ের মধ্যে আমরা সিঙ্গাপুরের চাঙি এয়ারপোর্ট ল্যান্ড করব, সেই সময় কিছুটা স্বস্তি এল মনে। তবে নির্ধারিত সময়ে উড়োজাহাজটি ল্যান্ড করতে পারছিল না। প্রায় ৫০ মিনিট ধরে চেষ্টা চলছিল। তখন যেন ভয় আরও বেড়ে গেল। সিঙ্গাপুরের স্থানীয় সময় বেলা ২টা ১০–এ ল্যান্ড করার কথা থাকলেও বেলা ৩টার সময় খুব বাজেভাবে ল্যান্ড করল স্কুট এয়ার লাইনসের উড়োজাহাজটি। আমরা চোখ বন্ধ করে ছিলাম। বেশ জোরে ঘর্ষণের শব্দও পেলাম। ল্যান্ড করার এক মিনিট পরও বিমানের ভেতরে থাকা যাত্রীরা ভাবছিলাম যে বিমানটা ঠিক আছে তো! দুর্ঘটনায় পড়িনি তো।

সৃষ্টিকর্তার ব্লেসিং ছিল বোধ হয়, তাই বেঁচে গেছি সেদিনের যাত্রায়। আজকের বিমান দুর্ঘটনা শুধু বারবার সে কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে।

আরও পড়ুন