যে মেডিকেল কলেজের এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থীই বিদেশি
বগুড়ার টিএমএসএস মেডিকেল কলেজে (টিএমসি) পা রেখেছিলাম ফাল্গুনের এক বিকেলে। করতোয়া নদীর পাশে সবুজে ঘেরা ক্যাম্পাস দেখে মন ভালো হয়ে যায়।
এমবিবিএস পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী শারীকা শাহরীন তখন ‘স্টুডেন্ট ডে’ উপলক্ষে আয়োজিত বার্ষিক সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার মহড়ায় ছুটছেন। জানালেন, মেডিকেলের কঠিন শিক্ষাজীবন শিক্ষার্থীদের কাছে আনন্দময় করতেই নানা রকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। নাচ ও গানের খণ্ডকালীন শিক্ষকও আছেন এখানে। পরিবার থেকে দূরে পাঁচটি আবাসিক হোস্টেলে শিক্ষার্থীরা থাকেন। দেশি-বিদেশি ছাত্রছাত্রী মিলে এখানে গড়ে উঠেছে আরেক পরিবার।
একনজরে
২০০৮ সালে বেসরকারি মেডিকেল কলেজটির যাত্রা শুরু হয়। বেসরকারি সংস্থা টিএমএসএসের নির্বাহী পরিচালক হোসেনে-আরা বেগম এর প্রতিষ্ঠাতা। অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন ডা. মো. জাকির হোসেন। তিনি রংপুর মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ।
বগুড়া শহর থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার উত্তরে ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের পাশে ৯ একর জায়গাজুড়ে টিএমএসএস মেডিকেল কলেজ। বর্তমানে কলেজে এমবিবিএস কোর্সে (১৫তম ব্যাচ) ৪৭৯ জন দেশি, ৩২৪ জন বিদেশিসহ (২৬২ জন ভারতীয় এবং ৬২ জন নেপালি) ৮০৩ জন শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছেন। এ ছাড়া ডেন্টাল বা বিডিএস কোর্সে (১১তম ব্যাচ) ২০৮ জন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন (বিএসএমএমইউ) ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন কোর্সে ৫ জন শিক্ষার্থী আছেন। নতুন করে এনাটমি, প্যাথলজি, শিশু, চক্ষু, ইএনটি বিভাগসহ আরও পাঁচটি বিষয়ে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন কোর্স চালু হয়েছে। শিক্ষক আছেন ২৭০ জন।
বিদেশি বন্ধুরা
টিএমসি ক্যাম্পাসের টু-ইন হোস্টেলে গেলে পাশাপাশি দুটি ছাত্রাবাস চোখে পড়ে। একটি দেশি, অন্যটি ভিনদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য। থাকার জায়গা ভিন্ন হলেও পড়ালেখা, আড্ডা, খেলাধুলা বা সংস্কৃতিচর্চায় কোনো ভেদাভেদ নেই। মিলেমিশেই হয় সব আয়োজন। নিজেদের ভাষায় গান ও নাচে অংশ নেন বিদেশি শিক্ষার্থীরাও। ভারতের আসাম থেকে আসা নয়না বড়ুয়া যেমন মণিপুরি নাচের জন্য ক্যাম্পাসে রীতিমতো তারকাখ্যাতি পেয়ে গেছেন। মণিপুরি নাচে মন কেড়েছেন ভারত থেকে আসা অরিজিৎ সিংও। ভারতীয় উপহাইকমিশনার এখানে এসে বিদেশি শিক্ষার্থীদের পরিবেশনা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন।
মাসুরা হোস্টেলের আবাসিক ছাত্রী সুমাইয়া আকতার তাবাসসুম বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ। আসাম থেকে আসা আসমা তারা এবং নেপাল থেকে আসা রেগা শ্রেষ্ঠা আমার সঙ্গেই পড়ে। তারা কোনো কিছু রান্না করলে আমাদের খেতে ডাকে। আবার আমরাও ভালো কিছু রান্না করলে তাদের আমন্ত্রণ জানাই। আমাদের বন্ধুত্বটা অন্য রকম।’
নেপালের রেগা শ্রেষ্ঠা বলেন, ‘বাঙালি সংস্কৃতি আমার খুব ভালো লাগে। প্রথম দিকে কিছুটা ভাষাগত সমস্যা হলেও এখন হয় না। এখানকার সবাই খুব আন্তরিক।’
আনন্দময় শিক্ষা
আমারা যেদিন টিএমসি ক্যাম্পাসে হাজির হয়েছি, সেদিন স্টুডেন্ট উইক উপলক্ষে সাংস্কৃতিক দল নিয়ে চলছিল মহড়া। জানা গেল, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ক্যাম্পাসের প্রাণ—কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক আজফারুল হাবিব। তাঁর নেতৃত্বেই সারা বছর চলে গান, নাচ, আবৃত্তিসহ সাংস্কৃতিক চর্চা। বিডিএস তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সুমাইয়া আকতার জানালেন, ক্যাম্পাসকে সব সময় মাতিয়ে রাখেন তাঁদের আরেক শিক্ষক ডা. নূর-এ ফারজানা। নাচ, গান, অভিনয় শেখান তিনি।
শিক্ষার্থীরাই উদ্যোগ নিয়ে চালু করেছেন ব্লাড ডোনেশন ক্লাব। আছে টিএমসি মেডিসিন ক্লাব, জার্নাল ক্লাব, স্পোর্টস ক্লাব, নাট্যদল ও ফটোগ্রাফি সোসাইটি ক্লাব। আন্তমেডিকেল ফুটবল টুর্নামেন্টে সাফল্য দেখিয়েছে স্পোর্টস ক্লাব।
এমবিবিএস চতুর্থ বর্ষের জিলকার নাঈম বলেন, ‘যেকোনো উৎসব-আয়োজনে এবং মানবিক কর্মকাণ্ডে ক্যাম্পাসভিত্তিক সংগঠনগুলো একে অপরের সাহায্যে এগিয়ে আসে। আমাদের এখানে পড়ালেখা শেষে চিকিৎসকেরা ছড়িয়ে পড়ছেন দেশের নানা জেলায়।’
স্টুডেন্ট উইকে যেমন সপ্তাহজুড়ে ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আয়োজন থাকে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবসগুলোও উদ্যাপন করা হয় গুরুত্বের সঙ্গে। হয় নাটকের মঞ্চায়ন। চিকিৎসাসেবায় শিক্ষার্থীদের দক্ষতা উন্নয়নে মেডিকেল স্কিল সেন্টার ও স্কিল ল্যাবরেটরি চালু হয়েছে। দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়ে সেমিনারও আয়োজন হয় এখানে।
টিএমসি কলেজ দেখভালের দায়িত্বে আছেন টিএমএসএসের উপনির্বাহী পরিচালক (স্বাস্থ্য) মতিউর রহমান। তিনি বলেন, ‘দক্ষতাসম্পন্ন ও মানবিক চিকিৎসক তৈরি করাই টিএমসির লক্ষ্য। পড়ালেখাকে আনন্দময় করতে এখানে ক্রীড়া-সংস্কৃতিসহ নানা সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে শিক্ষার্থীদের ব্যস্ত রাখা হয়।’ টিএমসির শিক্ষার্থীদের হাতেকলমে শিক্ষা ও শিক্ষানবিশির সুবিধার জন্য এখানে চালু আছে এক হাজার শয্যাবিশিষ্ট রফাতুল্লাহ কমিউনিটি হাসপাতাল এবং ২৫০ শয্যার ক্যানসার হাসপাতাল।