রাজশাহীতে এখন সর্বোচ্চ কত তলা দালান আছে?

৩০ বছর আগেও রাজশাহীর সবচেয়ে উঁচু ভবনটি ছিল ১০ তলা। আর এখন পদ্মাতীরের শহরটির সবচেয়ে বড় ভবনটি ২২ তলা। রাজশাহীর আবাসন নিয়ে লিখেছেন আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ

লেকের পাড় ধরে তৈরি হচ্ছে সারি সারি উঁচু দালানছবি: শহিদুল ইসলাম

কালের সাক্ষী হয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে জজ আদালত ভবন। ১৮৬৪-৬৫ সালে ফরাসি প্রকৌশলী ই এস বি পেরেইরার তত্ত্বাবধানে এটি নির্মাণ করেছিলেন রাজশাহীর বিখ্যাত নির্মাণশিল্পী কানু মিস্ত্রী ও বিনোদবিহারী মিস্ত্রী।

প্রায় দেড় শ বছরের ব্যবধানে এই শহরের নির্মাণশিল্পে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। তত দিনে বদলে গেছে শহরের নাম। বোয়ালিয়া থেকে রামপুর-বোয়ালিয়া আর রামপুর-বোয়ালিয়া থেকে রাজশাহী। নগরায়ণে যুক্ত হয়েছে আবাসন ব্যবসা। কানু মিস্ত্রী ও বিনোদবিহারীদের জায়গা নিয়েছে রাজশাহী রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড ডেভেলপার অ্যাসোসিয়েশন (রেডা)। 

এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৮০০ সালে গোটা বিশ্বে ৫ হাজার বা তার বেশি জনসংখ্যার শহর বা নগর ছিল ৭৫০টির মতো। সে সময় রামপুর-বোয়ালিয়া নিশ্চিতভাবে এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিল, কিন্তু শহরের কোনো প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা না থাকায় এটিকে ঠিক ষোলো আনা শহর বলাটা যৌক্তিক হবে না। নবাব মুর্শিদকুলি খান প্রতিষ্ঠিত ২৫ জমিদারির একটি ছিল রাজশাহী। তখন এর প্রশাসনিক দপ্তর ছিল নাটোর। ১৮২৫ সালে রামপুরে (বর্তমান রাজশাহী শহরের শ্রীরামপুর) স্থানান্তর করা হয় এর সদর দপ্তর। তখন আগের বোয়ালিয়ার সঙ্গে শ্রীরামপুরের নাম যুক্ত করে শহরের নাম লেখা শুরু হলো (‘শ্রী’ বাদ দিয়ে) রামপুর-বোয়ালিয়া। ১৮৫৫ সালে সব প্রশাসনিক ভবন পদ্মাগর্ভে বিলীন হয়ে গেলে নগরের বুলনপুরে, বর্তমানে যেখানে জজ আদালত ভবন, স্থানান্তরিত করা হয় প্রশাসনিক সদর দপ্তর। একে কেন্দ্র করে বিকশিত হতে থাকে নগর। বৃহত্তর রাজশাহীর রাজা, জমিদার, উকিল, মুক্তার, ব্যবসায়ীরা এসে বাড়িঘর নির্মাণ শুরু করেন। ১৯২৯ সালে হয় রেলস্টেশন। সাইনবোর্ডে লেখা হলো ‘রাজশাহী রেলস্টেশন’। সেই থেকে রামপুর-বোয়ালিয়ার পরিবর্তে শহরের নাম হলো রাজশাহী।

আরও পড়ুন
নবাব মুর্শিদকুলি খান প্রতিষ্ঠিত ২৫ জমিদারির একটি ছিল রাজশাহী।
ছবি: শহিদুল ইসলাম

বর্তমানে আবাসন প্রকল্পের সম্প্রসারণের কারণে রাজশাহী শহরের পদ্মা আবাসিক এলাকা, উপশহর, লক্ষ্মীপুর, সাহেববাজার, সাগরপাড়া, বর্ণালীর মোড়, সিপাইপাড়া, সিঅ্যান্ডবির মোড় এলাকাগুলো নগরবাসীর কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে বসবাসের জন্য সবচেয়ে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে পদ্মা আবাসিক এলাকা। 

আবাসন প্রকল্পের মাধ্যমে আমাদের আবাসন সমস্যার সমাধান হচ্ছে।  কারও একার পক্ষে যখন একটি বাড়ি করা সম্ভব হচ্ছে না, তখন এই প্রকল্পগুলো থেকে নগরবাসী উপকৃত হচ্ছেন। এদিক দিয়ে এটা একটা ইতিবাচক বিষয়। তবে এর সঙ্গে আরও বেশি নগর–পরিকল্পনাবিদদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে এগুলো নষ্ট না হয়। শুধু রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের একজন নগর–পরিকল্পক দিয়ে এটা সম্ভব নয়। তবে অন্য শহরের তুলনায় রাজশাহীর অবস্থা এখনো ভালো।
রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান অ্যান্ড রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ইলমী ফরিদাতুল
২২ তলা এ ভবনই এখন শহরের সবচেয়ে উঁচু দালান।
ছবি: শহিদুল ইসলাম
আরও পড়ুন

ভবন নিয়ে আলোচনা

আশির দশকের শেষ দিকে সিঅ্যান্ডবি মোড়ে এই শহরের প্রথম ১০ তলা ভবনটি নির্মাণ করে জীবন বীমা করপোরেশন। তখন সেটাই ছিল শহরের সবচেয়ে উঁচু দালান। এখনো শহরের মানুষ ১০ তলার আশপাশের এলাকা বোঝাতে ওই ১০ তলাকেই বুঝিয়ে থাকে। বর্তমানে নগরের লক্ষ্মীপুর এলাকায় শহরের সবচেয়ে উঁচু ভবনটি নির্মাণ করেছেন শহরের একদল চিকিৎসক। ২২ তলা এ ভবনই এখন শহরের সবচেয়ে উঁচু দালান।  

২০০৬ সালের দিকে রাজশাহীতে সীমিত আকারে বাণিজ্যিকভাবে আবাসন ব্যবসা শুরু হলো। দৈনিক বার্তা ভবন ছিল এই শহরের প্রথম মেগা প্রকল্প। ২০১৩ সালের দিকে শেষ হয় এটির কাজ। নির্মাণ করে রহমান ডেভেলপার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস। এখনো ভবনটি রাজশাহী শহরের সবচেয়ে বড় আয়তনের ভবন। ছয়তলা ভবনটির আয়তন ১ লাখ ১০ হাজার বর্গফুট। প্রতিটি মেঝের আয়তন ১৭ হাজার ৮০০ বর্গফুট।

২০১১ সালে শহরের কল্পনা হলের মোড়ে শুরু হয় ১৬ তলা একটি ভবন নির্মাণের কাজ। তখনকার সময় সেটিই ছিল শহরের সবচেয়ে উঁচু দালান। কল্পনা সিনেমা হল থাকার কারণে জায়গাটি কল্পনার মোড় বলে পরিচিত। পরে হলের নাম পরিবর্তন করে ‘উৎসব’ করা হলেও জায়গাটিকে নগরবাসী কল্পনার মোড় বলেই চিনত। ১৬ তলা এই স্বচ্ছ টাওয়ার নির্মাণের পর নতুন প্রজন্মের কাছে এই মোড়ের নাম এখন ‘স্বচ্ছ টাওয়ার’ মোড়। ‘কবির হোসেন’ নামের আবাসন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সিনেমা হল ভেঙে স্বচ্ছ টাওয়ার নির্মাণ করে। এতে ৬০টি ফ্ল্যাট ছাড়াও নিচে রয়েছে চারটি বাণিজ্যিক ফ্লোর। এই ভবন থেকে ছবির মতো দেখা যায় পদ্মা নদী। নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী কবির হোসেন জানান, তিনি এই শহরে প্রায় ৩০০টি ফ্ল্যাট নির্মাণ করেছেন। এর মধ্যে স্বচ্ছ টাওয়ার তাঁর আলোচিত কাজ। এটি মোট ৭ হাজার বর্গফুটের একটি ভবন।  

২০১৭ সালে গঠিত হয় রাজশাহী রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড ডেভেলপার অ্যাসোসিয়েশন (রেডা)
ছবি: শহিদুল ইসলাম

রেডা গঠন 

২০১২ সালের দিকে রাজশাহী শহরে আরও বিকশিত হয় আবাসন ব্যবসা। ২০১৭ সালে গঠিত হয় রাজশাহী রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড ডেভেলপার অ্যাসোসিয়েশন (রেডা)। সভাপতি হন রহমান ডেভেলপার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের স্বত্বাধিকারী তৌফিকুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক আল-আকসা ডেভেলপার প্রাইভেট লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী মিজানুর রহমান কাজী। তখন সংগঠনটির সদস্য ছিল ১৪-১৫টি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে সদস্যসংখ্যা ৩০। শহরের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ ভবন এই সংগঠনের সদস্যরাই নির্মাণ করেছেন বলে সংগঠনটির দাবি। এ ছাড়া বিক্ষিপ্তভাবে শতাধিক প্রতিষ্ঠান আবাসন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। তার সঙ্গে কমিউনিটিভিত্তিক ডেভেলপাররা কাজ করছে। জমির মালিকের সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতেও কিছু প্রতিষ্ঠান কাজ করছে।

আবাসনশিল্প সম্প্রসারণের কারণে এই শহরে তাঁরা প্রায় ৩০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান করতে পেরেছেন।
ছবি: শহিদুল ইসলাম

রেডার সভাপতি তৌফিকুর রহমান জানান, তাঁদের প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ড হচ্ছে দিমা। এটি একটি আরবি শব্দ। অর্থ নিরবচ্ছিন্ন বারিধারা। রাজশাহীতে দিমা ব্র্যান্ড দুই শতাধিক ফ্ল্যাট নির্মাণ করেছে। এখন পর্যন্ত তাদের তৈরি বড় ভবন হচ্ছে দৈনিক বার্তা ভবন। 

রেডার সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান কাজী জানান, তাঁরাও রাজশাহী শহরে দুই শতাধিক ফ্ল্যাট নির্মাণ করেছেন। তাঁদের ব্র্যান্ড হচ্ছে আল-আকসা। মিজানুর রহমান জানান, রাজশাহীতে বড় কোনো কলকারখানা গড়ে ওঠেনি। একমাত্র আবাসনশিল্পই বিকশিত হচ্ছে। এই শিল্পে ৫৪০টি প্রতিষ্ঠানের উপকরণের প্রয়োজন পড়ে। লাগে ২৪০টি উপখাতের উপকরণ। ১৪ ধরনের মিস্ত্রির প্রয়োজন হয়। সব মিলিয়ে এই শিল্প সম্প্রসারণের কারণে কর্মসংস্থানহীন এই শহরে তাঁরা প্রায় ৩০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান করতে পেরেছেন। প্রতিটি পরিবারে চারজন করে সদস্য থাকলেও এই শহরের মোট ১ লাখ ২০ হাজার মানুষের অন্ন–বস্ত্রের ব্যবস্থা আবাসনশিল্প থেকে হচ্ছে। বর্তমানে অবস্থানভেদে এই শহরে সাড়ে ৪ হাজার টাকা থেকে ৬ হাজার টাকা বর্গফুট হারে ফ্ল্যাট বিক্রি হচ্ছে।

আরও পড়ুন
পদ্মা–তীরবর্তী শান্তির শহর বলে পরিচিত এ শহরে বসতি গড়েছেন সারা ভারতবর্ষের মানুষ। এখন আবাসন প্রকল্প নিয়ে ডেভেলপার কোম্পানিগুলো এসেছে। নিজের জমিতে বা জমি কিনে ভবন করার সামর্থ্য যাঁদের নেই, তাঁদের জন্য একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে।
নগর–বিশ্লেষক আহমদ সফিউদ্দিন

এই নগরে সবচেয়ে বেশি ফ্ল্যাট নির্মাণ করেছে পারফেক্ট লিভিং প্রপার্টিজ লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী শিহাব পারভেজ। তিনি জানান, নগরের উপশহর এলাকায় সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন তাঁরা। রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ) নির্ধারিত মান অনুযায়ী আবাসিক এলাকাটি নির্মিত হচ্ছে বলে সেটি শহরের সবচেয়ে মানসম্মত আবাসিক এলাকা। এ প্রতিষ্ঠানের প্রকল্পের সংখ্যা ৫০। এতে ফ্ল্যাট রয়েছে ৭৫০টি। বর্তমানে খানসামার চক এলাকায় তাদের ১ লাখ বর্গফুট আয়তনের সবচেয়ে বড় নির্মাণকাজটি চলমান। শিহাব পারভেজ জানান, তাঁরাই নগরের কুমারপাড়া এলাকায় একটি ভবন নির্মাণ করে আড়ং, লা রিভ ও টুয়েলভের মতো দেশি বড় ব্র্যান্ডগুলোকে রাজশাহীতে নিয়ে এসেছেন। শিহাব পারভেজ জানান, রাজশাহীতে এই শিল্পের বিকাশের কারণে ঢাকা থেকে অনেক কর্মচারী এখন রাজশাহীতে নিজের বাড়িতে থেকে কাজ করছেন। তাঁদের প্রতিষ্ঠানেই এ রকম ৫৫ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী রয়েছেন।

রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ) অথরাইজ অফিসার আবুল কালাম আজাদ জানান, প্ল্যান অনুমোদনের তথ্য অনুযায়ী, রাজশাহী শহরে বর্তমানে সাত বা তার চেয়ে উঁচু ভবনের সংখ্যা প্রায় ২০০। এর মধ্যে কিছু নির্মাণাধীন ভবনও অবশ্য আছে। সন্ধ্যা নামলেই ভবনগুলোর চূড়ায় নিয়ন আলোয় জ্বলে ওঠে একেকটি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের নাম।

রাজশাহী শহরে বর্তমানে সাত বা তার চেয়ে উঁচু ভবনের সংখ্যা প্রায় ২০০
ছবি: শহিদুল ইসলাম

নগর–বিশ্লেষক আহমদ সফিউদ্দিন বলেন, পদ্মা–তীরবর্তী শান্তির শহর বলে পরিচিত এ শহরে বসতি গড়েছেন সারা ভারতবর্ষের মানুষ। এখন আবাসন প্রকল্প নিয়ে ডেভেলপার কোম্পানিগুলো এসেছে। নিজের জমিতে বা জমি কিনে ভবন করার সামর্থ্য যাঁদের নেই, তাঁদের জন্য একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। তবে আরডিএর মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে তার সঙ্গে মিলিয়ে নগরায়ণ হলে আরও ভালো হতো।

রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান অ্যান্ড রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ইলমী ফরিদাতুল বলেন, ‘আবাসন প্রকল্পের মাধ্যমে আমাদের আবাসন সমস্যার সমাধান হচ্ছে।  কারও একার পক্ষে যখন একটি বাড়ি করা সম্ভব হচ্ছে না, তখন এই প্রকল্পগুলো থেকে নগরবাসী উপকৃত হচ্ছেন। এদিক দিয়ে এটা একটা ইতিবাচক বিষয়। তবে এর সঙ্গে আরও বেশি নগর–পরিকল্পনাবিদদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে এগুলো নষ্ট না হয়। শুধু রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের একজন নগর–পরিকল্পক দিয়ে এটা সম্ভব নয়। তবে অন্য শহরের তুলনায় রাজশাহীর অবস্থা এখনো ভালো।’