আইস ফেশিয়াল কি মুখের ত্বকের জন্য সত্যিই উপকারী
নিয়মিত মুখে বরফ ঘষেন অনেকে। মনে করেন, এর অনেক উপকার। কেউ বলেন, বরফ ব্রণের সমস্যা দূর করে। কারও দাবি, এতে মুখের ফোলা ভাব কমে এবং ত্বক টান টান হয়। অথচ বৈজ্ঞানিকভাবে এসব দাবির তেমন কোনো প্রমাণ নেই। তাহলে মুখে বরফ লাগালে আদতে কোনো উপকার পাওয়া সম্ভব কি?
শরীরের কোনো অংশে বরফ প্রয়োগ করাকে বলে ‘কোল্ড থেরাপি’ বা ‘ক্রায়োথেরাপি’। এ পদ্ধতিতে আঘাতের চিকিৎসা করা হয়। ব্যথার স্থানে বরফ লাগালে তিনটি ব্যাপার ঘটে—১. স্নায়ুর কার্যকলাপ সাময়িকভাবে কমে গিয়ে ব্যথা উপশম করে, ২. ব্যথার স্থানে রক্তপ্রবাহ কমিয়ে ফোলা ভাব কমায় এবং ৩. নরম টিস্যুর পুনরুদ্ধারপ্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে।
কেন হঠাৎ জনপ্রিয়
আজকাল সামাজিক মাধ্যমগুলোয় রূপচর্চাবিষয়ক বিভিন্ন জনপ্রিয় কনটেন্টের একটি হচ্ছে আইস ফেশিয়াল। মুখে বরফ ঘষে ফেসবুক-টিকটকের রিলস তৈরি করছেন অনেকে। সঙ্গে জানাচ্ছেন এর স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্যগত নানা উপকারিতার কথা।
মুখের ত্বকে বরফ লাগানোর ব্যাপারটি হঠাৎ এত জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পেছনের কিছু কারণ হচ্ছে—এতে কোন খরচ নেই বললেই চলে।
সহজে করা যায়।
অনেকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আছে।
ইন্টারনেটে ব্যাপক প্রচারিত।
রাসায়নিকমুক্ত প্রাকৃতিক পদ্ধতির রূপচর্চা।
দেখতে যৌক্তিক ও নিরাপদ মনে হয়।
কিন্তু মনে রাখা জরুরি, এসব দাবির বেশির ভাগই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে শেয়ার করা। এখন পর্যন্ত সেসবের কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ বা নির্দিষ্ট গবেষণা পাওয়া যায়নি। তাই নিজে নিজে আইস ফেশিয়াল করতে চাইলে এর সম্ভাব্য উপকারিতা, ঝুঁকি এবং মুখে বরফ প্রয়োগ করার সঠিক কৌশলগুলো আগেই জেনে নিন।
আইস ফেসিয়ালের উপকারিতা
মুখের ফোলা ভাব দূর করতে: বরফ মুখের ফোলা ভাব, বিশেষ করে চোখের নিচের অংশের ফোলা ভাব কমাতে সাহায্য করে। আমেরিকান একাডেমি অব অফথালমোলজির পরামর্শমতে, চোখের নিচে ফোলা ভাব কমাতে ১৫–২০ মিনিট হালকা চাপ দিয়ে ঠান্ডা কমপ্রেস ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে সাময়িকভাবে ত্বকের রক্তনালি সংকুচিত হয়। এর ফলে ওই স্থানে রক্তপ্রবাহ কমে যায় এবং প্রদাহজনিত কোষগুলো মুখে পৌঁছাতে পারে না, যা ফোলা ভাব কমাতে সাহায্য করে। এই প্রক্রিয়াকে বলে ‘ভ্যাসোকনস্ট্রিকশন’। তবে মুখের ফোলা ভাব পুরোপুরি দূর করতে বরফের কার্যকারিতা নিয়ে সরাসরি কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণা নেই।
ব্রণের জন্য বরফ: অনেকেই মনে করেন, ত্বকে বরফ ঘষলে প্রদাহ কমে এবং রোমকূপ বা পোরস সংকুচিত হয়, ফলে অতিরিক্ত তেল উৎপাদন কমে। বরফের প্রদাহনাশক বৈশিষ্ট্যের কারণে সিস্ট, নডিউল, পাস্টিউল ও প্যাপিউল–জাতীয় প্রদাহজনিত ব্রণের ক্ষেত্রে কিছুটা উপশম হতে পারে। ব্রণের জন্য বরফ ব্যবহার করলে বরফ ও বরফ প্যাঁচানোর কাপড় বা টিস্যু বারবার পরিবর্তন করুন, যাতে ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে না পড়ে। মনে রাখবেন, বরফ কখনোই আপনার নিয়মিত স্কিনকেয়ার রুটিনের বিকল্প নয়।
অন্যান্য উপকারিতা: ত্বকে বরফ ব্যবহারের কিছু প্রচলিত, তবে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণহীন কয়েকটি উপকারিতা হলো—
ত্বকের অতিরিক্ত তেল কমায়।
রোদে পোড়া ত্বক ঠান্ডা করে।
র্যাশ বা পোকামাকড়ের কামড়জনিত ফোলা কমায়।
বলিরেখা বা বার্ধক্যের লক্ষণ হ্রাস করে।
ত্বকে প্রাকৃতিক উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে।
ঝুঁকি
মুখে বা শরীরের অন্য কোনো অংশে সরাসরি ও দীর্ঘ সময় ধরে বরফ প্রয়োগ করলে কিছু ঝুঁকি থাকতে পারে। যেমন—
অস্থায়ী অবশ ভাব
আইস বার্ন বা ঠান্ডাজনিত পোড়া দাগ।
নার্ভ ইনজুরি বা স্নায়ুতে আঘাত।
ফ্রস্টবাইট বা অতিরিক্ত ঠান্ডায় ত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া।
স্পর্শ অনুভূতিকে প্রভাবিত করে, এমন কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা, যেমন ডায়াবেটিস বা রেনডস সিনড্রোম থাকলে মুখে বরফ লাগানো এড়িয়ে চলা উচিত।
সঠিক পদ্ধতি
আইস ফেশিয়ালের সমর্থকেরা মুখে সাধারণত দুটি পদ্ধতিতে বরফ ব্যবহার করতে বলেন।
১. নরম কাপড়: একটি নরম সুতি কাপড়ে ৪–৫টি বরফকুচি মুড়ে নিয়ে ত্বকে ব্যবহার করুন।
২. সরাসরি হাতে: দুই হাতে একটি করে দুটি বরফকুচি নিয়ে মুখে লাগান।
দুই ক্ষেত্রেই আলতো করে বৃত্তাকারে ১–২ মিনিট ধরে মুখে মালিশ করুন। বরফ কখনোই সরাসরি ২ মিনিটের বেশি লাগাবেন না, এতে ত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
চোয়াল, থুতনি, ঠোঁটের চারপাশ, নাক, গাল ও কপালে প্রতিদিন একবার আলতো করে বরফ মালিশ করা যেতে পারে।
তৈরি করুন পানি ছাড়া বরফ
চা বা কফি: বরফ শুধু পানি দিয়েই নয়, চা বা কফির মতো ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় দিয়েও তৈরি করা যেতে পারে বলে দাবি করেন আইস ফেশিয়ালের সমর্থকেরা। অনেক ময়েশ্চারাইজার ও ত্বকের যত্নের পণ্যেও ক্যাফেইন থাকে। কারণ, এটি সূর্যের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে ত্বককে কিছুটা সুরক্ষা দিতে পারে, বলিরেখা কমাতে সহায়তা করে এবং রক্ত সঞ্চালন বাড়াতে পারে।
অ্যালোভেরা: ত্বকের নানা সমস্যায় অ্যালোভেরা বা ঘৃতকুমারীর রস ব্যবহার করা হয়। ন্যাশনাল সেন্টার ফর কমপ্লিমেন্টারি অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটিভ হেলথ (এনসিসিআইএইচ) জানায়, পোড়া ত্বক দ্রুত সারাতে এবং ব্রণ প্রশমিত করতে অ্যালোভেরা ভালো কাজ করে। বরফ আকারেও অ্যালোভেরা তার আরোগ্যক্ষমতা বজায় রাখে। তাই অ্যালোভেরা বরফ করে বা বরফ লাগানোর আগে ত্বকে অ্যালোভেরার রস লাগিয়ে নিতে পারেন।
গ্রিন–টি: গ্রিন–টির ‘ক্যাটেচিন’ উপাদানটির জীবাণুনাশক, প্রদাহরোধী ও অ্যান্টিভাইরাল বৈশিষ্ট্য আছে। এসব সূর্যের ক্ষতি থেকে ত্বককে সুরক্ষা দিতে এবং ত্বকের পুনরুদ্ধারে সাহায্য করতে পারে বলে ধারণা করা হয়।
দরকারি পরামর্শ
১. মুখে বরফ ব্যবহারের জন্য আলাদা আইস ট্রে ব্যবহার করুন এবং প্রতিবার ব্যবহারের পর সেটি পরিষ্কার করুন।
২. বরফ লাগানোর আগে মুখ ভালোভাবে ধুয়ে নিন।
৩. মুখ থেকে গলে পড়া পানি মুছতে পরিষ্কার কাপড় বা টিস্যু রাখুন।
৪. বরফ ও ত্বকের মধ্যে একটি কাপড় বা টিস্যুর স্তর রাখুন। এটি ত্বক ও হাতকে রক্ষা করবে।
৫. বরফ অনেকক্ষণ ধরে এক জায়গায় ধরে রাখবেন না, এতে আইস বার্ন হতে পারে।
চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে কখন
বরফ ব্যবহার করার এক সপ্তাহের মধ্যেও মুখের ফোলা ভাব, ব্রণ বা সূর্যের পোড়া দাগ না সারলে।
বরফ লাগানোর পর যদি অবশ ভাব, জ্বালাপোড়া অনুভূতি বা ফ্রস্টবাইট (ত্বক জমে যাওয়া) হয়, তাহলে অবিলম্বে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।
সূত্র: হেলথলাইন