আপনি মাঝারি পর্যায়ের ম্যানেজার হয়েই থাকবেন—যদি না এটা করেন

আপনি হয়তো অনেক বছর ধরে টিম ম্যানেজ করছেন, কাজের ফলাফল ভালো, সবাই আপনাকে নির্ভরযোগ্য বলে। বস বলেন, ‘তুমি খুব সলিড, ইনডিসপেনসেবল।’ কিন্তু পদোন্নতির সময় দেখা যায়, বেছে নেওয়া হলো অন্য কাউকে—যিনি আপনার মতো অভিজ্ঞ নন, কাজেও নন ততটা পারদর্শী। সমস্যা আদতে কোথায়? এমন পরিস্থিতিতে আপনি হয়তো তখন ভাবেন, ‘আমি কী ভুল করলাম?’ উত্তরটা কঠিন, কিন্তু সত্যি—পরিশ্রম আপনাকে নির্ভরযোগ্য করে, প্রভাবশালী নয়।

সবাই জানে, আপনি ছাড়া কাজ থেমে যাবে, কিন্তু কেউ কল্পনাও করে না যে আপনি নেতৃত্বও দিতে পারেনমডেল: কোকো। ছবি: কবির হোসেন

‘ভালো কর্মী’ হওয়াই যখন আপনার পথের কাঁটা

মিড লেভেল বা মাঝারি পর্যায়ের ম্যানেজারদের বড় অংশ সারাক্ষণ কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। মিটিং, ডেডলাইন, রিপোর্ট, টিমের ঝামেলা, সবকিছু ঠিকঠাক রাখা—এসবেই দিন কেটে যায়। বসের জীবন সহজ করেন, সমস্যা মেটান, ডেলিভারি দেন।

কিন্তু এর ফল কী হয়, জানেন?

আপনি হয়ে যান ‘অপরিহার্য’, কিন্তু ‘অদৃশ্য’। সবাই জানে, আপনি ছাড়া কাজ থেমে যাবে, কিন্তু কেউ কল্পনাও করে না যে আপনি নেতৃত্বও দিতে পারেন।

এ কারণেই হয়তো আপনি অনেক ভালো কাজ করেও পদোন্নতি পান না। কারণ, পদোন্নতি শুধু ‘ভালো কাজ’-এর জন্য নয়, ‘ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের সম্ভাবনা’ দেখানোর জন্যও হয়।

মিড লেভেল বা মাঝারি পর্যায়ের ম্যানেজারদের বড় অংশ সারাক্ষণ কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকেন
মডেল: কোকো। ছবি: কবির হোসেন

বসেরা যা দেখেন

আপনি হয়তো ভাবছেন, এত ভালো কাজ করেও কেন উন্নতি মিলছে না। কারণটা বোঝার জন্য একটা সত্যি জানা দরকার।

উচ্চপর্যায়ের নেতৃত্ব আপনার প্রেজেন্টেশনের স্লাইডে রঙিন কেপিআই (কী পারফরম্যান্স ইন্ডিকেটর) দেখেন না। তাঁরা দেখেন আপনি অফিসে এসে কীভাবে আলোচনাটা এগিয়ে নিচ্ছেন।

আপনি শুধু বলছেন, ‘এই কাজটা শেষ হয়েছে’, নাকি বলছেন, ‘এটা আমাদের বাজারে টিকে থাকার কৌশলের সঙ্গে কতটা মানানসই?’

যাঁরা পদোন্নতি পান, তাঁরা ‘কী হয়েছে’ নয়, বলেন, ‘এরপর কী হতে পারে’।

তাঁরা প্রশ্ন করেন—

  • আমরা কী মিস করছি?

  • এটা প্রতিষ্ঠানের বড় লক্ষ্যের সঙ্গে কী খাপ খাচ্ছে?

  • আমরা যদি কাজটা বড় পরিসরে করি, কোথায় গিয়ে গড়বড় বাধবে?

এভাবেই তাঁরা নিজেদের দৃশ্যমান করেন। এটাই ‘স্ট্র্যাটেজিক ভিজিবিলিটি’, যেখানে আপনি শুধু কাজ করছেন না, বরং পথের দিশা দিচ্ছেন।

আরও পড়ুন

ঝুঁকি না নিলে নেতৃত্ব দেওয়া যায় না

ছেলেবেলা থেকে আমাদের বলা হয়, ‘অতি বাড় বেড়ো না, ঝড়ে পড়ে যাবে...’। কথাটা একঅর্থে ঠিক, তবে আমাদের মনে গেঁথে যায়—সব সময় মাটির দিকে তাকিয়ে চলো, বড় হয়ো না। আর এই মানসিকতাই সবচেয়ে বড় ফাঁদ।

কারণ, অফিসের বসরা আদতে ‘ইয়েস স্যার’–জাতীয় কর্মী খোঁজেন না, তাঁরা খোঁজেন এমন ব্যক্তিকে, যাঁরা সাহস করে প্রশ্ন করবে, ভিন্ন দৃষ্টিকোণ দেবে, নতুন কিছু ভাবাবে।

আপনি যদি কখনো এমন কোনো আইডিয়া না দেন, যা শুনে কেউ বলে ‘বাহ্, বেশ সাহসী প্রস্তাব!’ তাহলে আপনি এখনো ‘কমফোর্ট জোনে’ আছেন।

আর এই কমফোর্ট জোনেই ক্যারিয়ার থেমে যায়।

মনে রাখবেন—

  • ঝুঁকি নেওয়া মানেই বেপরোয়া হওয়া নয়।

  • এটা মানে নতুন পথ দেখানো, আলোচনার বিষয় বদলে দেওয়া, সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলা।

  • নেতৃত্ব মানে শুধু টিম সামলানো নয়, প্রতিষ্ঠানকে সামনের দিকে টেনে নেওয়া।

আপনার রিপোর্ট যতই সুন্দর হোক, যদি সেখানে কিছু প্রশ্নের উত্তর না থাকে, বসরা মনোযোগ হারাবেন
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

‘আমার টিম’ নয়, বলুন ‘আমাদের কাজ’

যখন আপনি বসদের সামনে কিছু উপস্থাপন করেন, তাঁরা জানতে চান না আপনার টিম কত কাজ করল। তাঁরা জানতে চান—

  • এতে গ্রাহক কতটা লাভবান হবে?

  • এটা কীভাবে আমাদের খরচ কমাবে?

  • এটা কোম্পানির ভবিষ্যৎ কৌশলে কী অবদান রাখছে?

আপনার রিপোর্ট যতই সুন্দর হোক, যদি সেখানে এসবের উত্তর না থাকে, বসরা মনোযোগ হারাবেন।

অন্যদিকে কেউ যদি সরাসরি বলে, ‘এই কাজটা করলে গ্রাহক হারানোর ঝুঁকি কমবে, যা বছরে আট কোটি টাকা সাশ্রয় করবে।’ তাহলে সবাই কান পেতে শুনতে বাধ্য হবে।

কারণ, এসবই ব্যবসার ভাষা, সম্ভাবনার ভাষা। তাই আপনাকেও ব্যবসায়িক ভাষায় নিজের কাজের প্রভাব বোঝানো শিখতে হবে।

আরও পড়ুন

পদোন্নতি কেবল আপনার বসের হাতে নয়

ভাবতে পারেন, আমি ভালো কাজ করছি, একদিন না একদিন কেউ দেখবেই। দুঃখজনকভাবে, বাস্তবটা এমন নয়। বাস্তবতা হলো কেউ আপনার পক্ষে কথা না বললে, আপনি পদোন্নতির তালিকায় থাকবেন না।

যিনি পদোন্নতি পান, খেয়াল করে দেখবেন, তাঁর পেছনে কেউ না কেউ থাকেন। হতে পারে অফিসের কোনো জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা, যিনি বলেন, ‘আমি ওর ওপর ভরসা রাখি, ও কঠিন পরিস্থিতিতে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে।’

এই বিশ্বাসই হলো ক্যারিয়ারের মই। তাই কেবল আপনার ম্যানেজারের সঙ্গে নয়, বরং সেসব সিদ্ধান্তগ্রহণকারীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ুন, যাঁরা প্রতিষ্ঠানের দিক নির্ধারণ করেন।

ক্রস-ফাংশনাল প্রজেক্টে যুক্ত হোন, কঠিন সমস্যায় এগিয়ে যান, পরামর্শ চান, প্রতিক্রিয়া নিন এবং ধীরে ধীরে তাঁদের আস্থা অর্জন করুন।

এটা তোষামোদ নয়, এটা হলো ‘পাওয়ার অ্যালাইনমেন্ট’।

অফিসে উন্নতি চাইলে নেতার মতো ভাবুন, কাজ করুন, কথা বলুন
মডেল: কোকো। ছবি: কবির হোসেন

শেষ কথা

আপনি হয়তো হতাশ হয়ে ভাবতে পারেন, অফিসে আমি একটা জায়গায় আটকে আছি; কারণ, আমি যথেষ্ট ভালো নই।

আদতে আপনি আটকে আছেন কেউ আপনাকে ‘দেখছে’ না বলে। আপনি কারও নজরে পড়ছেন না। আপনি শুধু কাজ করেন, প্রতিষ্ঠানে দিক নির্দেশ করেন না। আপনি সবার জীবন সহজ করে দেন, কিন্তু নিজের জীবন এগোয় না।

তাই আপনাকে বুঝতে হবে, আপনি শুধু কাজ ভালোভাবে শেষ করতে পারেন না, আপনি নেতৃত্বও দিতে পারেন।

আপনি যদি আজ বসে বসে ভাবেন, ‘আর কী করলে হবে?’

তাহলে এটাই উত্তর—

  • অপেক্ষা বন্ধ করুন।

  • নিজের জায়গার দাবি তুলুন কাজের মাধ্যমে।

  • নেতার মতো ভাবুন, কাজ করুন, কথা বলুন।

  • প্রমাণ করুন, আপনি ইতিমধ্যে সেই উঁচু পদের উপযুক্ত।

সূত্র: মিডিয়াম

আরও পড়ুন