একবার না, পরপর দুইবার ফেল করেছি

হলিউড অভিনেতা কেন জিয়ংকে লোকে হ্যাংওভার ছবির ‘মিস্টার চাও’ হিসেবেই চেনেন বেশি। অনেকে জানেনই না, এই অভিনেতা পেশায় একজন চিকিৎসক। সম্প্রতি কেন বক্তৃতা দেন যুক্তরাষ্ট্রের টুলানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে।

কেন জিয়ং
ছবি: রয়টার্স

অভিনন্দন তোমাদের। আমার ধারণা, তোমরা হলে এ যাবৎকালের সবচেয়ে শক্ত মনোবলসম্পন্ন আর সহিষ্ণু ব্যাচ, যারা অকল্পনীয় প্রতিকূলতা পেরিয়ে অবশেষে সমাবর্তন পেতে যাচ্ছ।

ভেবে দেখো, বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের প্রথম বছর পেরিয়ে মাত্র যখন দ্বিতীয় বছর শুরু করেছিলে তোমরা, ঠিক তখনই কোভিড নামের মহামারি পৃথিবীতে হানা দেয়। তোমাদের লকডাউন পার করতে হয়েছে, অনলাইন ক্লাস করতে হয়েছে। ভ্যাকসিন, অমিক্রন, বুস্টার—কত কিছুর মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। কোনো কিছুই তোমাদের দমাতে পারেনি। বরং এসব অভিজ্ঞতা আর প্রতিকূলতা তোমাদের আরও শক্ত করেছে। আর এই শক্তিকে পুঁজি করেই এখন নতুন জীবনে পা রাখতে যাচ্ছ তোমরা। শুরু করতে যাচ্ছ নতুন সংগ্রাম। তোমাদের আর কী উপদেশ দেব! পরিস্থিতিই আগামীর জন্য তোমাদের প্রস্তুত করেছে।

কয়েক বছর ধরে তোমরা অধ্যবসায়ের চর্চা করছ। এ জন্য আজ এই আসরে তোমরা উপস্থিত হতে পেরেছ। সামনের দিনগুলোতেও এই চর্চা চালিয়ে যাও। তাহলেই আর কোনো উপদেশের প্রয়োজন পড়বে না।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

সাফল্যের মূল মন্ত্র

প্রায়ই লোকে আমার কাছে জানতে চায়, ‘তোমার সাফল্যের মূল মন্ত্র কী? শুধুই মেধা? নাকি ভাগ্য? না অন্য কিছুও আছে?’ আমি জবাব দিই, ‘এর কোনোটাই নয়।’ তোমাদের উদ্দেশে আজ আমি আমার সাফল্যের মূল মন্ত্রটি বলতে চাই। সেটা হলো—অধ্যবসায়।

মিশেল ওবামা বলেছেন, ‘বড় বড় অর্জনের জন্য কোনো জাদু জানতে হয় না। শুধু কঠোর পরিশ্রম আর অধ্যবসায় থাকলেই যথেষ্ট।’ মার্কিন সিনেটর বিল ব্র্যাডলি বলেছেন, আকাঙ্ক্ষা সফলতার দিকে যাওয়ার পথ দেখায়। আর অধ্যবসায় হলো সেই পথ ধরে সাফল্যের দিকে যাওয়ার একমাত্র বাহন।

আমি নিজে জীবনে কতবার হোঁচট খেয়েছি, ব্যর্থ হয়েছি, কিন্তু হাল ছাড়িনি। চেষ্টা চালিয়ে গেছি। আমি হচ্ছি অধ্যবসায় চর্চার জলজ্যান্ত উদাহরণ।

স্ত্রী ট্র্যান জিয়ংয়ের সঙ্গে কেন
ছবি: রয়টার্স

দুইবার ফেল

জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়ে আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসি। আমি ছিলাম ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলাইনার (ইউএনসি) মেডিকেল স্কুলের ছাত্র। কিন্তু বারবার ফেল করার কারণে যখন আমার আত্মবিশ্বাস তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিলে, তখন আমি নিউ অরলিন্সে এসে টুলানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকি। মেডিকেল স্কুলে একদমই ভালো করতে পারছিলাম না। বোর্ড পরীক্ষায় একবার না, পরপর দুইবার ফেল করি। যেখানে আজীবন আমাকে শেখানো হয়েছে, জীবনে কোনো দিন ফেল করা যাবে না, সেখানে দুইবার ফেল করে আমার পুরো জীবনটাকেই মনে হচ্ছিল ব্যর্থ। বুঝতে পারছিলাম না, মেডিকেলে পড়ার ক্ষমতা আদৌ আমার আছে কি না। আদৌ চিকিৎসক হওয়ার যোগ্য কি না আমি। নিজেকে মনে হচ্ছিল এক গোলকধাঁধার ভেতর বন্দী।

আমি কে? আমি কী করতে চাই? আমার আসলে কোন দিকে টান? আমার ক্ষমতা কতটুকু? এসব কিছু বোঝার জন্য আমার একটু সময়ের দরকার ছিল। তাই আমি পড়াশোনা থেকে এক বছরের বিরতি নিই। স্বাধীনভাবে নিজের মতো করে পড়াশোনা করতে শুরু করি। ওই সময় ইউএনসির অধ্যাপক ড. রয় অরল্যান্ড টুলানে মেডিকেল স্কুলে গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগে প্রধান হয়ে আসেন। ইউএনসি মেডিকেল স্কুলে এই শিক্ষকই ছিলেন আমার মেন্টর। আমি প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা থেকে এক বছরের বিরতি নিয়েছি, জানতে পেরে আমাকে তিনি ডেকে পাঠান এবং তাঁর তত্ত্বাবধানে আমাকে একটি বিশেষ গবেষণা দলে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানান। এভাবেই তিনি আমাকে এবং আমার ক্যারিয়ারকে সে যাত্রায় রক্ষা করেছিলেন।

আমি তাঁর ল্যাবে নিয়মিত কাজ শুরু করি। আর ফাঁকে ফাঁকে নিউ অরলিন্সের বিভিন্ন শো আর ক্লাবে স্ট্যান্ড–আপ কমেডি করতে থাকি। বছরের শেষে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজির ওপর করা আমার গবেষণাটি নিবন্ধ আকারে ছাপা হয়েছে। পরে সেই গবেষণাপত্র জমা দিয়েই আমি ইউএনসি থেকে গ্র্যাজুয়েশন করে বেরিয়ে আসি।

সহিষ্ণুতার চর্চা

অল্প কথায় বলতে গেলে, ছোট্ট একটা বিরতি, নিজের জন্য একটু সময় আমাকে আমার শক্তি, আমার ক্ষমতা নতুন করে উপলব্ধি করতে শেখায়। ওই বছর আমি আবার বোর্ড পরীক্ষা দিই এবং প্রথম দফাতেই পাস করি। সাফল্যের সঙ্গে মেডিকেল স্কুল থেকেও বেরিয়ে আসি। এভাবেই জীবন আমাকে দ্বিতীয় সুযোগ দেয় নিজের ক্যারিয়ারকে সঠিক পথে আনার, আর আমিও সেটা লুফে নিই।

এখন তোমরা প্রশ্ন করতে পারো, জীবনে আমি যদি কমেডিয়ানই হতে চেয়েছিলাম, তাহলে চিকিৎসক হওয়ার জন্য এত কিছু কেন করলাম? কী দরকার ছিল মেডিকেলে পড়ার?

দরকার ছিল। জীবনে একবার কোনো একটা বিষয়ে হার মেনে নিলে, হার মানায় আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাব। পরে মন থেকে যেটা করতে যাব, সেখানেও হয়তো একটু বাধা পেলেই হার মেনে ফেলব। একবার হার মানলে, বারবার হার মানতে হয়। তাই হার মানা যাবে না। অধ্যবসায় ধরে রাখতে হবে, সহিষ্ণু হতে হবে। আমরা কেউই জানি না, ভবিষ্যৎ আমাদের জন্য কী নিয়ে অপেক্ষা করছে। তাই নিজেকে অদেখা সেই ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করো। শক্ত হও। সহিষ্ণুতার চর্চা করো।

আমার মতো মানুষ যদি এ পর্যন্ত আসতে পারে, তোমরা কেন পারবে না? আমাকে দেখো। ব্যর্থতার পর পাওয়া দ্বিতীয় সুযোগ আমাকে কোথায় নিয়ে এসেছে! মাইকেল জর্ডান একবার বলেছিলেন, ‘আমি ব্যর্থ হয়েছি। একবার না, বারবার। এটাই আমার সফলতার মূল মন্ত্র।’

ইংরেজি থেকে অনুদিত

সূত্র: টুলানে ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইট