প্রথম উপার্জনে কেনা প্রথম ঈদ উপহার
টিউশনি থেকে শুরু করে খণ্ডকালীন চাকরি, আছে ফ্রিল্যান্স কাজ, অনেকে আবার নিজস্ব ব্যবসাও শুরু করছেন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পা রেখেই স্বাবলম্বী হতে চেষ্টা করেন অনেক শিক্ষার্থী। নিজে আয় করার আনন্দই আলাদা। আর প্রথম আয়ের টাকায় প্রিয়জনের জন্য ঈদ উপহার কেনার আনন্দ? কয়েকজন শিক্ষার্থীর কাছে সেই গল্প শুনলেন রাফিয়া আলম
‘এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে?’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আসিফ আলী। ২০২২ সাল থেকে ঈদ অন্য রকম আনন্দ নিয়ে ধরা দিচ্ছে তাঁর কাছে। সে বছরই প্রথম নিজের উপার্জনে মা আর দাদির জন্য শাড়ি কেনেন তিনি। কামিজের কাপড়ও নিয়েছিলেন মাকে দেবেন বলে। বাবার জন্য কেনা হয়েছিল শার্টের কাপড় আর লুঙ্গি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগে জীবিকার তাগিদে হোটেলে, খেতে বা সবজির দোকানে কাজ করেছেন। সে সময় কিন্তু এই সবকিছুই করতে পারতেন না আসিফ। বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেই জীবনটা বদলে গেল। পড়ালেখার পাশাপাশি খণ্ডকালীন চাকরি নিলেন আসিফ। ছুটির দিনে পূর্ণ সময় দেন।
এ ছাড়া টিউশন করেন নিয়মিত। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান এলাকায় সাইকেল চালিয়ে যেতে-আসতে প্রচণ্ড পরিশ্রম হয়। মাঝেমধ্যে মনে হয়, ছেড়ে দিই। কিন্তু পড়ালেখার পাশাপাশি এই পরিশ্রমের কারণেই একটু সচ্ছলতা পেয়েছি। আগে আমার পরিবার ঈদের কেনাকাটার সুযোগ পায়নি। এখন ঈদের আনন্দ আসে আমার পরিবারেও। সন্তান হিসেবে মা-বাবার জন্য এতটুকু করতে পারছি, এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে!’ বলছিলেন আসিফ। এবার মা-বাবা, দাদি ছাড়াও বোন ও দুলাভাইয়ের জন্যও উপহার কিনেছেন তিনি। রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার সন্তান আসিফ নিজে বাড়ি যাওয়ার আগেই বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন ঈদ উপহার। প্রথমবার মা-বাবা খুশিতে কেঁদে ফেলেছিলেন। প্রতিবেশীরা কেউ নতুন পোশাকের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে গর্বের সঙ্গে বলেছিলেন সন্তানের উপার্জনের কথা। সেবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁদের ছবিও শেয়ার করেছিলেন আসিফ। সেই ছবি আর ছবির নিচের ইতিবাচক মন্তব্যের কথা জেনেও দারুণ খুশি হয়েছিলেন তাঁরা। এই ছোট্ট ছোট্ট মুহূর্তগুলোর সঙ্গে কি আর কোনো কিছুর তুলনা চলে?
তবু ঈদ আসে
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থী আরিফ ফয়সাল স্কুলজীবনেই বাবাকে হারিয়েছেন। তিন সন্তানকে নিয়ে জীবনসংগ্রামে নামেন মা। স্নাতক পর্যায়ের পড়ালেখা শেষ না হতেই মাকেও হারান ফয়সাল। তাই চট্টগ্রামে নিজের খরচ তো বটেই, নোয়াখালীতে নিজেদের সংসারের খরচও তাঁকেই জোগাতে হয়। ভাইটি স্কুলপড়ুয়া। পড়ালেখার দায়িত্ব নিয়েছেন ফয়সাল। চট্টগ্রাম শহর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় বেশ দূরে। শহর থেকে টিউশন সেরে রাতে হলে ফেরার ঝক্কি এড়াতে তাই হল ছেড়ে শহরেই থাকছেন তিনি। একটা চাকরি ভীষণ প্রয়োজন ছিল। মা-বাবাকে হারিয়ে আত্মীয়স্বজনের থেকেও নেতিবাচক আচরণ পেয়েছেন। ‘অভিভাবকহীন’ হওয়ায় বড় বোনের বিয়ের সম্বন্ধ করতেও বিপাকে পড়েছেন।
মায়ের মৃত্যুর পর থেকে ঈদের দিনটাও বড় বেদনাদায়ক তাঁদের কাছে। তবু ভাইয়ের জন্য পাঞ্জাবি কিনেছেন ফয়সাল। আরও কিছু কিনবেন ভেবেছেন। বোনের জন্য কী কিনবেন, ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারেন না। তবে সেটিও শিগগিরই হবে বলে আশা রাখেন।
উপহার পাওয়ার চেয়ে দেওয়ার আনন্দই এখন বড়
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রফি আহমেদ টিউশনি করেই দাঁড়িয়েছেন পরিবারের পাশে। বলছিলেন, ‘ছোটবেলায় ঈদ উপহার পেতে ভালো লাগত। এখন উপহার পাওয়ার চেয়ে দেওয়ার আনন্দটাই বড় মনে হয়। প্রথম যখন মা-বাবাকে ঈদের উপহার দিলাম, তাঁরা আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন। বোনকে যখন দোকানে ইচ্ছামতো জিনিস পছন্দ করতে বলেছিলাম, তার চোখেমুখে ছিল খুশির ঝিলিক।’
নানা-নানি, মামা আর মামাতো ভাইয়ের জন্যও উপহার কিনছেন তিনি। ছোটদের ঈদের সালামিও দেন। সংসার চালাতে মা-বাবার কষ্টটা একটু হলেও উপলব্ধি করেন রফি। অনুভব করেন অভাবী মানুষের কষ্টও। তাই প্রতি মাসেই অভাবী মানুষকে কিছুটা সাহায্য করেন, ঈদেও তেমনটা করার ইচ্ছা আছে।
ঈদ নিয়ে এমন আরও জল্পনা-কল্পনা
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিক্ষানবিশ চিকিৎসক নূরে তাবাস্সুম জানালেন, ছাত্র অবস্থায় কখনো টিউশনি করাননি। শিক্ষানবিশিই তাঁর প্রথম উপার্জন। মা, ভাই-বোন আর বোনের বাচ্চাদের জন্য প্রথমবারের মতো ঈদের কেনাকাটা করার কথা ভাবতেই দারুণ লাগছে বলে জানালেন।
একই রকম ভাবনা ভাবছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শফিকুল ইসলাম। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রবেশের আগেও নরসিংদীতে বাড়ির কাছে ছোটখাটে টিউশনি করেছেন। তবে এবারই প্রথম পরিবারের জন্য ঈদের কেনাকাটার সুযোগ পেয়েছেন। মায়ের জন্য থ্রি-পিস, বাবার জন্য পাঞ্জাবি-লুঙ্গি আর বোনের জন্য শাড়ি কেনার ইচ্ছে আছে; একমাত্র ভাগনি আর ভাইয়ের জন্যও উপহার নেবেন। প্রচণ্ড গরমে এই রমজান মাসেও কষ্ট করে টিউশনির কষ্টটাই নাকি ভুলে যাবেন শফিকুল, যখন খুশিতে ঝলমল করবে প্রিয় মুখগুলো।