আটলান্টিক সাগরে ভেসে কেমন কাটছে সাবিতের সময়
জাতিসংঘের ‘সমুদ্রবিজ্ঞান দশক’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে ‘ফ্লোটিং সামার স্কুল’। বিশ্বব্যাপী তিন হাজার আবেদনকারীর মধ্য থেকে ২০ জনকে মাসব্যাপী সমুদ্র গবেষণার জন্য বাছাই করা হয়েছে। তাঁদের একজন সাবিত হোসেন। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থী এখন আছেন আটলান্টিক মহাসাগরে। তাঁর অভিজ্ঞতা শুনেছেন নোমান মিয়া
যেদিকে দুচোখ যায়, শুধু পানি আর পানি। আটলান্টিক মহাসাগরে ভাসছে জার্মানির গবেষণা ও বরফভাঙা জাহাজ ‘পোলারস্টার্ন’। এই জাহাজই যেন একদল তরুণ গবেষকের ‘ক্লাসরুম’। ল্যাবরেটরিও বলা যায়। ল্যাবে ভেসে সকাল–সন্ধ্যা চলছে তাঁদের ক্লাস। এই ক্লাসে ঘণ্টা পড়ার কোনো নিয়ম নেই। তরুণেরা যা দেখছেন, যা শুনছেন, যা বুঝছেন, সবটাই জমা হচ্ছে অভিজ্ঞতার ঝুলিতে।
সমুদ্র গবেষণা হাতেকলমে শেখার জন্য জাহাজটিতে আছেন ২০ দেশের ২০ জন তরুণ। তিন হাজার আবেদনকারীর মধ্য থেকে তাঁদের বাছাই করা হয়েছে। তাঁদের একজন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাবিত হোসেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। স্নাতকোত্তর পর্যায়ে তাঁর থিসিসের কাজ চলছে।
জাতিসংঘের ‘সমুদ্রবিজ্ঞান দশক’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে পোলারস্টার্ন জাহাজে ‘ভাসমান গ্রীষ্মকালীন গবেষণা বিদ্যালয়’ পরিচালনা করছে জার্মানির হেলমহোল্টজ সেন্টার ফর পোলার অ্যান্ড মেরিন রিসার্চ (এডব্লিউআই)। সহযোগিতায় আরও আছে জার্মানির আলফ্রেড ভেগেনার ইনস্টিটিউট, পোগো, জাপানের নিপ্পন ফাউন্ডেশন, আয়ারল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব গলওয়ে ও ট্রিনিটি কলেজ ডাবলিনের চেয়ার অব ক্লাইমেট সায়েন্সেস। পঞ্চমবারের মতো এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পরিচালনা করছে এডব্লিউআই।
পোলারস্টার্নেই আছেন বাংলাদেশের আরও একজন। তিনি শাবিপ্রবির সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান সুব্রত সরকার। বিভিন্ন দেশ থেকে পাঁচজন প্রশিক্ষককে বাছাই করা হয়েছিল। সুব্রত তাঁদের মধ্যে স্থান পেয়েছেন।
প্রশিক্ষণ জাহাজটি জার্মানির ব্রেমারহ্যাভেন বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে ১৩ নভেম্বর। আগামী ১২ ডিসেম্বর নামিবিয়ার ওয়ালভিস বে বন্দরে পৌঁছানোর কথা রয়েছে। সমুদ্রপথেই গবেষণা, ক্লাস, পরীক্ষা, সমুদ্রের তলদেশের জরিপসহ বিভিন্ন কাজ করবেন গবেষকেরা।
তরুণ গবেষক সাবিত হোসেন বলছিলেন, ‘আমাদের পাঁচটি মডিউলে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। সমুদ্রবিজ্ঞান, সমুদ্র মডেলিং, পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি, জলবায়ু পরিবর্তন, বিজ্ঞান প্রচার ও দর্শন। এক সপ্তাহে সাগরের বিভিন্ন গভীরতা থেকে পানি ও পরিবেশের তথ্য সংগ্রহ করার জন্য সিটিডি রোসেট পরিচালনা, প্ল্যাঙ্কটন স্যাম্পলিং, আন্ডারওয়ে প্রোফাইলিং (চলমান অবস্থায় তথ্য সংগ্রহ), সমুদ্রের তাপমাত্রা পরিমাপক যন্ত্র এক্সবিটি ও জলবায়ুসংশ্লিষ্ট তথ্য বিশ্লেষণের মতো উন্নত সমুদ্রবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি হাতেকলমে শিখছি।’
সকাল থেকেই শুরু হয় প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। নাশতার পর থাকে বিভিন্ন মডিউলের ক্লাস। দুপুরের খাবারের পর সমুদ্রের বিভিন্ন স্থানে আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেন গবেষকেরা। গভীর সমুদ্রে থাকলেও স্টারলিংকের সহযোগিতায় যেকোনো সময় দেশে যোগাযোগ করতে পারছেন সাবিত।
উন্নত গবেষণার হাতেখড়ি হচ্ছে বলে জানান শাবিপ্রবির এই শিক্ষার্থী। সাবিত হোসেন বলেন, ‘আন্তর্জাতিক গবেষকদের সঙ্গে কাজ করে বৈশ্বিক মান, নৈতিকতা ও টিমওয়ার্ক শিখেছি। সমুদ্র কীভাবে জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ করে তা গভীরভাবে বুঝেছি। বাংলাদেশের উপকূলীয় সমস্যা মোকাবিলায় এ জ্ঞান কাজে লাগবে। ব্লু ইকোনমি ও টেকসই উন্নয়নে অবদান রাখতে পারব। এই প্রশিক্ষণ আমাকে আরও বড় স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে। দেশের সমুদ্রবিজ্ঞানকে এগিয়ে নিতে এখন আমি আরও প্রস্তুত।’
সামুদ্রিক গবেষণার সক্ষমতা বিনিময়—এ প্রশিক্ষণ কর্মসূচির অন্যতম লক্ষ্য জানালেন প্রশিক্ষক সুব্রত সরকার। তিনি বলেন, ‘সমুদ্র গবেষণায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে অভিনব ভাসমান গবেষণাপদ্ধতি। তরুণ গবেষকেরা মাসব্যাপী হাতেকলমে সবকিছু শিখছেন। নিজ নিজ দেশে গিয়ে তাঁরা সমুদ্র গবেষণার পথিকৃৎ হিসেবে ভূমিকা রাখবেন বলে আমরা আশাবাদী।’