যে বিশ্ববিদ্যালয়ে নোবেলজয়ীদের গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য আলাদা জায়গা আছে
বিশ্বের নানা বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ছেন বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনোটা শত বছরের পুরোনো, কোনোটায় শিক্ষক হিসেবে আছেন একাধিক নোবেলজয়ী অধ্যাপক। স্বনামধন্য এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অভিজ্ঞতা কেমন? পড়ুন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলির পিএইচডি শিক্ষার্থী মাসুমা মল্লিকার লেখা।
ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (আইইউটি) থেকে ব্যাচেলর করে বার্কলিতে পড়তে আসি। প্রথমে মাস্টার্স, এখন পিএইচডি।
স্নাতকের সময় থেকেই দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলাম। সেই সময় থেকেই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত থেকেছি, শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাজ নিয়মিত অনুসরণ করেছি। ধাপে ধাপে প্রস্তুতি নিয়েছি। শেষ পর্যন্ত বার্কলিতে সুযোগ পাওয়াটা ছিল স্বপ্ন পূরণের মতো।
প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা ছিল মিশ্র—একদিকে কিছুটা ভয়, অন্যদিকে প্রবল উৎসাহ। নবীনবরণ অনুষ্ঠানের শুরুতেই আমাদের বিভাগের প্রধানের সঙ্গে দেখা হয়, যাঁর অনেক গবেষণা আইইউটিতে পড়ার সময় থেকেই আগ্রহ নিয়ে অনুসরণ করতাম। তাঁর সঙ্গে সরাসরি দেখা হওয়ায় ভীষণ অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। পরে ক্যাম্পাস ঘুরে দেখার সময় এমন গবেষণাগার ও ভবন দেখেছি, যেখানে ওপেনহেইমারের মতো কিংবদন্তি বিজ্ঞানীরা কাজ করেছেন। এখানে নোবেলজয়ীদের গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য আলাদা জায়গা আছে।
ক্যাম্পাসের যে বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করেছে, তা হলো এখানকার সবাই খুব উদার। মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী। যেকোনো বিষয়ে মুক্তভাবে মতপ্রকাশের সুযোগ আছে, এমনকি যদি সেটি অপ্রাসঙ্গিক বা কিছুটা অবান্তরও হয়, তবু তা বলার পরিবেশ আছে। শুরুতে বিষয়টা আমাকে কিছুটা বিস্মিত করেছিল। পরে বুঝেছি, শেখার প্রক্রিয়ায় এটা অনেক সহায়ক।
আরেকটা দারুণ দিক হলো, যদিও এখানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা অনেক বেশি, তবু সহযোগিতার মনোভাবে কমতি নেই। সবাই একে অন্যকে সাহায্য করে, একসঙ্গে কাজ করে। এই সহযোগিতার সংস্কৃতি খুব ভালো লেগেছে।
আর সবচেয়ে ভালো দিক হলো, এখানকার মানুষ। শুরু থেকেই আমি অনেকের সঙ্গে মিশেছি, বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছি। আন্তরিক পরিবেশটাই আমাকে সবচেয়ে বেশি টেনেছে। বিশেষ করে ইন্টারন্যাশনাল হাউসে থাকাটা খুব উপভোগ করেছি। পরিবেশটা এতটাই বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল যে মনে হতো সবাই মিলে একটা পরিবার।
পড়াশোনার ফাঁকে একটু হেঁটে বেড়ানো বা কাছাকাছি কোথাও ঘুরতে যাওয়ার জন্য এখানকার আবহাওয়া একদম উপযোগী। বার্কলি নিজেই একটি প্রাণবন্ত ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক শহর, আর খুব কাছেই আছে সান ফ্রান্সিসকোসহ অনেক দর্শনীয় জায়গা। পরিবহনব্যবস্থা ভালো হওয়ায় অল্প সময়েই এসব জায়গায় যাওয়া যায়।
সময় কাটানোর জন্য আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা লাইব্রেরি। এখানে বিশটির বেশি লাইব্রেরি আছে। সম্প্রতি আমরা বাংলাদেশি স্টুডেন্টস অ্যান্ড স্কলার্স অ্যাট বার্কলি (বিএসএসবি) নামে একটি সংগঠন করেছি। এই কমিউনিটির সঙ্গে যুক্ত থাকা, বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন এবং দেশের সংস্কৃতি বাইরের মানুষের কাছে তুলে ধরাও সময় কাটানোর প্রিয় উপায়।
বার্কলিতে শেখার পদ্ধতি একটু ভিন্ন। এখানে ভালো করতে হলে বিষয়টা ঠিকমতো বুঝতে হয়। শুধু মুখস্থ করলেই হয় না—বোঝা, বিশ্লেষণ আর প্রয়োগ করতে পারাটাও জরুরি। আরেকটা বিষয় হলো, এখানে পাঠ্যসূচি নিয়মিত বদলায়। সময়ের সঙ্গে যোগ হয় নতুন নতুন বিষয়, যাতে করে আমরা আধুনিক বিষয় শিখতে পারি। এখানে শিক্ষকেরা বেশ ভালো প্রস্তুতি নিয়ে শিক্ষার্থীদের সামনে হাজির হন। তাঁরা শুধু পড়ান না, বরং কীভাবে ভালোভাবে শেখানো যায়, সেটা নিয়েও কাজ করেন। এ জন্য তাদের আলাদা প্রশিক্ষণ আর সহায়তাও থাকে। এই কাঠামোগত সহযোগিতাটা বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এখনো অনেকাংশে অনুপস্থিত।
আমার মনে হয়, বার্কলিতে এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় সম্মিলিত কাজ আর গবেষণাভিত্তিক শেখার ওপর। সবাই এখানে নিজের কাজটা ভালোভাবে করার পাশাপাশি অন্যদের সঙ্গে মিলে কাজ করতেও উৎসাহিত হয়।
আরেকটা বিষয় খুব গুরুত্ব পায়। তা হলো, বার্কলি অনার কোড। যেখানে বলাই আছে, ইউসিবি কমিউনিটির সদস্য হিসেবে সততা, দায়িত্ববোধ আর অন্যের প্রতি সম্মান—এই তিনের চর্চা করতেই হবে। এই নীতি শুধু পড়াশোনায় নয়; গবেষণা, গ্রুপওয়ার্ক বা যেকোনো কাজে মেনে চলা হয়।
ছোটদের জন্য আমার প্রথম পরামর্শ হবে, ভালো সিজিপিএ ধরে রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ভালো রেজাল্ট শুরুতেই এগিয়ে রাখে, অনেক জায়গায় প্রাথমিক বাছাইয়ে এটি বড় ভূমিকা রাখে। দ্বিতীয়ত, পাঠ্যবইয়ের বাইরে ক্লাব বা স্বেচ্ছাসেবার মতো কার্যক্রমে যুক্ত থাকাটা অনেক কাজে দেয়। এতে নেতৃত্ব ও দায়িত্ববোধ শেখা যায়, যা ভর্তির আবেদনকে আরও শক্তিশালী করে। আর গ্র্যাজুয়েট স্কুলে আসার জন্য আন্ডারগ্র্যাড থেকেই কিছুটা গবেষণার সঙ্গে যুক্ত থাকা ভালো। ছোট পরিসরের প্রজেক্ট বা কোনো শিক্ষককে সহযোগিতা, ছোটখাটো সম্মেলনে লেখা প্রকাশের অভিজ্ঞতাও খুব কাজে দেয়। এক কথায় ভালো ফলাফল, সামাজিক সম্পৃক্ততা আর গবেষণার প্রাথমিক অভিজ্ঞতা—এই তিনটি জিনিস একজন শিক্ষার্থীকে অনেক বেশি সাহায্য করে।