যুক্তরাষ্ট্র থেকে সৈয়দপুর, তারপর বিমানবন্দর থেকেই সোজা সমাবর্তনে

আয়োজনটা উৎসবমুখর করতে তাই চেষ্টার কমতি রাখেনি কর্তৃপক্ষ।ছবি: প্রথম আলো

‘সমাবর্তন অনুষ্ঠান ছিল গত ২২ নভেম্বর। সেদিন সকালেই সৈয়দপুর বিমানবন্দরে নেমেছি। আগে থেকেই মা–বাবা অপেক্ষা করছিলেন। তাঁদের সঙ্গে নিয়ে বিমানবন্দর থেকেই সোজা ক্যাম্পাসে গিয়ে অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছি। প্রায় আট বছর পর ফিরলাম। ক্লান্তি ছিল। কিন্তু রোমাঞ্চ তার চেয়ে বেশি।’ কথাগুলো বলছিলেন দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) দ্বিতীয় সমাবর্তনে অংশ নেওয়া এক প্রাক্তন শিক্ষার্থী। ২০১৮ সালে স্নাতক শেষে উচ্চশিক্ষার জন্য চলে গিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। এখন সেখানে ইউনিভার্সিটি অব আরকানসাস ফর মেডিকেল সায়েন্সেসে পিএইচডি করছেন। নাম জিজ্ঞাসা করতেই বলেন, ‘জীবনে তো এখনো কিছু করতে পারিনি। আরও বড় কিছু করি, তারপর নাহয় নাম লিখবেন।’

ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্স অনুষদের এই ছাত্রের মতোই ‘বড় কিছু’ করার স্বপ্ন হাবিপ্রবির আরও বহু শিক্ষার্থীর। প্রায় দেড় দশক পর ক্যাম্পাসে সমাবর্তন অনুষ্ঠান হলো। আয়োজনটা উৎসবমুখর করতে তাই চেষ্টার কমতি রাখেনি কর্তৃপক্ষ। শুধু দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নয়, প্রবাসে থাকা শিক্ষার্থীরাও হাজির হয়েছিলেন সেদিন।

আরও পড়ুন

পরনে কালো গাউন, মাথায় টুপি। প্রিয় বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে চলছিল উষ্ণ অভ্যর্থনা ও হইহুল্লোড়। কান পাতলেই শোনা যাচ্ছিল, ‘আছিস কেমন’, ‘কত দিন পর’, ‘দাড়িও রেখেছিস!’, ‘মোটা হয়েছিস’, ‘ছেলে–মেয়ে কয়টারে তোর...’। কেউ গলা ছেড়ে গান গেয়েছেন। দেশ, রাজনীতি ও নির্বাচনও উঠে এসেছে আড্ডায়। ছিল সেলফি ও ছবি তোলার হিড়িক।

মূল অনুষ্ঠান ছিল দুপুরে। অতিথি হিসেবে বিজয়–২৪ হলের মাঠে উপস্থিত ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা চৌধুরী রফিকুল আবরার ও অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।

প্রায় দেড় দশক পর ক্যাম্পাসে সমাবর্তন অনুষ্ঠান হলো, তাই আনন্দ ছিল একটু বেশি
ছবি: প্রথম আলো

কত যে গল্প সমাবর্তন অনুষ্ঠানের আনাচকানাচে! সুইডেন থেকে নাইম উদ দৌলা যেমন বন্ধুদের বলে দিয়েছিলেন, ‘আসব না রে।’ কিন্তু তিনিও হাজির হয়ে চমকে দিয়েছেন সবাইকে। কৃষি অনুষদের ২০১৪ ব্যাচের এই শিক্ষার্থী এখন সুইডেনের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বিপণন সহকারী পদে কর্মরত আছেন। সস্ত্রীক সমাবর্তনে যোগ দিয়েছেন তিনি। বলছিলেন, ‘বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না যে সমাবর্তনে আসা হবে। কারণ, এর আগে কয়েকবার সমাবর্তন আয়োজন ভেস্তে গেছে। যখন দেখলাম সত্যি সত্যি আয়োজনটা হচ্ছে, স্ত্রীসহ নিবন্ধন করে ফেলি। একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলে বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করি। বন্ধুদের উপস্থিত হওয়ার জন্য উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু শুরু থেকেই বলে আসছিলাম, আমি আসব না। বন্ধুরাও বারবার বলছিল, “তোকে আসতেই হবে। সমাবর্তন কি জীবনে বারবার আসে?” আমি দেশে এসেছি নভেম্বরের মাঝামাঝি, ঢাকায়ই ছিলাম। অনুষ্ঠানের আগের দিন বিকেলে যখন গাউন তুলতে গিয়েছি, তখন সবার সঙ্গে দেখা। সেই মুহূর্ত বলে বোঝানোর মতো নয়। ব্যাচে ৩৫০ জনের মধ্যে প্রায় ৩২০ জনকেই পেয়েছি।’

ক্যাম্পাসের কাছেই একটা ভাতের হোটেল চালান আজাহার ইসলাম। তাঁর হোটেলে শিক্ষার্থীদের কেউ বাকি খান, কেউ কম দাম দিয়ে বেশি খাবার খান, কেউ আবার তৃপ্তিসহকারে খেয়ে ভালোবেসে বেশি টাকাও দেন। সবার কাছে ‘বন্ধু’ বলেই তিনি পরিচিত। প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা ভিড় করেছিলেন ‘বন্ধু’র দোকানেও। প্রকৌশল অনুষদের ২০১৮ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন সোয়াদুজ্জামান। বর্তমানে হবিগঞ্জে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘ক্যাম্পাস থেকে দেওয়া খাবারের প্যাকেট বন্ধুকে দিয়েছি। আমার দুই খালা এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষার্থী ছিলেন। দুপুরে স্ত্রী ও দুই খালাকে নিয়ে বন্ধুর হোটেলে খেয়েছি। রান্নার সেই স্বাদ এখনো আগের মতোই আছে।’

২০১৭ ব্যাচের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন মাহফুজুর রহমান। সিজিপিএ ৪.০০–এর মধ্যে ৩.৯৮ পেয়ে অনার্স শেষ করেছেন। বাবা কৃষক। পরিবারে মাহফুজুরই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। আর এবার পেলেন ‘চ্যান্সেলর পদক’। তিনি বলেন, ‘এত বড় আয়োজন! বড় ভাই ও বন্ধুদের কাছে পেয়েছি। ভীষণ ভালো লেগেছে। যাঁরা ব্যক্তিজীবনে ও কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, এমন অনেকের সঙ্গেই দেখা হয়েছে। কথা হয়েছে। নানা পরামর্শও পেয়েছি।’ চ্যান্সেলর পদক প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, ‘যখন আমার নাম ঘোষণা করা হলো, সত্যি অনেক ভালো লাগছিল। মনে হচ্ছিল, মা–বাবার কষ্ট ও পরিশ্রম কিছুটা হলেও সার্থক করতে পেরেছি।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন অধ্যাপক এম এনামুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘কৃষিপ্রধান উত্তরাঞ্চলে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে শিক্ষা ও কৃষি উন্নয়নে দারুণভাবে অবদান রাখছে। প্রায় দেড় দশক পর দ্বিতীয় সমাবর্তনে উৎসবমুখর পরিবেশে শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বাস ও আনন্দ দেখে এটাই প্রতীয়মান হয়েছে। তবে দুই যুগ অতিক্রম করলেও এখনো নানা ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার বিশ্ববিদ্যালয়টি। বিগত সরকারের উদাসীনতা ও বাজেটের স্বল্পতায় শিক্ষার্থী ও গবেষকদের যুগোপযোগী অবকাঠামো, একাডেমিক ভবন, আধুনিক যন্ত্রপাতিসমৃদ্ধ গবেষণাগার ও আবাসিক হল নির্মিত হয়নি। এসব বিষয়ে সরকার সুদৃষ্টি রাখলে এখানকার শিক্ষার্থীরাই প্রমাণ করতে সক্ষম হবে—হাবিপ্রবিয়ান ও হাবিপ্রবিই দেশসেরা।’

আরও পড়ুন