১৮০ জন ফুটবলারের অটোগ্রাফ আছে বাহারুলের কাছে
দেশের একসময়ের তারকা ফুটবলার কাজী সালাহউদ্দিন, আশরাফউদ্দিন চুন্নু, মোনেম মুন্নাসহ হালের তপু বর্মণের অটোগ্রাফও সংগ্রহ করেছেন কুমিল্লার লালমাইয়ের বাহারুল আলম। শুধু ফুটবলারই নয়, সংগঠক, গায়ক, অভিনেতাদেরও অটোগ্রাফ শিকার করেছেন। এই ফুটবল–ভক্তের গল্প শোনাচ্ছেন মাসুদ আলম
ইদ্রিস মিয়া ছিলেন এলাকার নামকরা ফুটবলার। ফরোয়ার্ডে খেলতেন। তাঁর সেই ফুটবলপ্রীতি সন্তান বাহারুল আলমও পেয়েছেন। নিজেও স্কুল-কলেজ পর্যায়ে ফুটবল খেলা শুরু করলেন। তবে একসময় পায়ে চোট পেয়ে খেলোয়াড়ি জীবন থেকে সরে যেতে হলো। তবে খেলার নেশা ছাড়ল না।
খেলা দেখতে ঢাকা স্টেডিয়ামে ছুটে আসতেন। ১৯৭৫ সালে ঢাকায় আগমন। ঢাকার শাহজাহানপুরে থাকতেন বাহারুলরা। কুমিল্লা-ফেনী-নোয়াখালীর ফুটবলপাগল অনেকে ট্রেনে এসে খিলগাঁও রেলগেটে নেমে জাতীয় স্টেডিয়ামে যেত।
এই ফুটবল সমর্থকদের অনেকে এসে তাঁদের বাসায় উঠত। বাহারুলের স্মৃতিতে সে ছিল দেশের ফুটবলে স্মরণীয় এক সময়, ‘তখন মতিঝিল সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট স্কুল থেকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের পাশ দিয়ে ফকিরাপুল হয়ে ব্রাদার্স সমর্থকদের মিছিল যেত জাতীয় স্টেডিয়ামে। দেশের ফুটবলে এমন দিন কখনো ভোলার নয়।’
ঝালমুড়ি, ছোলাবুট, কাসুন্দি দিয়ে নারকেলের টুকরা খাওয়া—বাহারুল আলমের জিবে এখনো লেগে আছে। তাঁর হৃদয়ের বড় অংশজুড়ে শুধুই ফুটবল। পেছন ফিরে বলেন, ‘১৯৮১ সালে আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচের দুই ঘণ্টা আগে আবাহনী ক্লাবে যাই। কাজী সালাহউদ্দিনকে বলি, আপনি ১০ নম্বর জার্সি পরে খেলেন। আমাকে দশটা অটোগ্রাফ দিতে হবে। সালাহউদ্দিন ভাই আন্তরিকতার সঙ্গে সাড়া দেন, কষ্ট করে এসেছ, ঠিক আছে, দশটি অটোগ্রাফই দিলাম। এ ছিল আমার বিরাট সৌভাগ্য।’
তবে তারও আগে ঢাকা মোহামেডানের রাইট আউট কোহিনূরের অটোগ্রাফ নেন প্রথম। সর্বশেষ অটোগ্রাফ নিয়েছেন গত বছর, জাতীয় দলের ক্রিকেটার মোস্তাফিজুর রহমানের। দীর্ঘ ৪৩ বছরে সংগ্রহ করেছেন তিন শতাধিক অটোগ্রাফ, যার মধ্যে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ১৮ জনসহ ১৮০ জনই ফুটবলার। পঞ্চাশ-ষাট দশক থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের ফুটবলারও আছেন। সবাই শীর্ষস্তরের ফুটবলার।
আবাহনীর প্রথম অধিনায়ক আবদুস সাদেক, প্রখ্যাত ফুটবলার জাকারিয়া পিন্টু, প্রতাপশঙ্কর হাজরা, নওশেরুজ্জামান, রণজিৎ দাস, গোলাম সারোয়ার টিপু, কাজী সালাহউদ্দিন, এনায়েতুর রহমান খান, মোহাম্মদ মালা, সুলতান আহমেদ, হাসানুজ্জামান বাবলু, শামসুল আলম মঞ্জু, আশরাফউদ্দিন চুন্নু, বাদল রায়, মোনেম মুন্না, শেখ আসলাম, আবদুল গাফফার, কাজী আনোয়ার, আশীষ ভদ্র, মোহাম্মদ মহসীন (গোলকিপার), মোহাম্মদ মহসীন (স্ট্রাইকার), ওয়াসিম ইকবাল, জসিম উদ্দিন জোসী, সৈয়দ রুম্মান বিন ওয়ালী সাব্বির, কায়সার হামিদ, আমিনুল হক, আলফাজ আহমেদ, ইমতিয়াজ আহমেদ নকীব, হালের তপু বর্মণ—কত অটোগ্রাফ।
সাবেক ফুটবলার ও অভিনেতা কাবিলাও বাদ যাননি। সুনামগঞ্জে তাঁর বাড়িতে গিয়ে নিয়েছেন ছোট নাজিরের অটোগ্রাফ।
শুধু খেলোয়াড় নয়, সংগঠক, গায়ক, অভিনেতা—অনেকেরই অটোগ্রাফ শিকার করেছেন। সাতারু ব্রজেন দাস, ক্রিকেটার রকিবুল হাসান, গাজী আশরাফ হোসেন লিপু, দাবাড়ু রানী হামিদ, নিয়াজ মোরশেদ, ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় কামরুন নাহার ডানা থেকে শুরু করে বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদী, আপেল মাহমুদ, সাবিনা ইয়াসমীন, সুবীর নন্দী, ফরিদা পারভীন, নায়করাজ রাজ্জাক, হাসান ইমাম, আফরোজা বানু, ক্রীড়া সাংবাদিক কামারুজ্জামান, ধারাভাষ্যকার আবদুল হামিদসহ আরও অনেকের অটোগ্রাফ তাঁর সংগ্রহে আছে।
অটোগ্রাফ, ঠিকানা, সংবাদপত্রের কাটিং, ফটোকপি—সব মিলিয়ে অটোগ্রাফের ফাইলের সংখ্যা ৩৪। পেপার কাটিংয়ের ফাইল ৬টি। জাতীয় দলের ফুটবলারদের ঠিকানা, ফোন নম্বর মিলিয়ে দুটি। মোট ৪২টি ফাইল। শুধু সংগ্রহ নয়, বাহারুল গড়ে তুলেছেন ব্যক্তিগত ক্রীড়া জাদুঘর। যেখানে ফুটবলারের ছবি, বই, পেপার কাটিং সাজানো। যেন অন্য এক সময়ে ঢোকার প্রবেশদ্বার।
এই শখের পেছনে আছেন লালমাইয়ের বাগমারা গার্লস হাইস্কুলের শিক্ষিকা নুরজাহান আক্কাস। সত্তর দশকের শেষ দিকে তিনি বিভিন্ন তারকাদের চিঠি লিখে অটোগ্রাফ সংগ্রহ করতেন। ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে চিঠি পাঠালে তিনি ডাকযোগে অটোগ্রাফ পাঠান। ওই অটোগ্রাফটা কিশোর বাহারুলকে দেখান শিক্ষিকা নুরহাজান। কিশোর বাহারুলকে পেয়ে বসে সেই নেশা।
আজকের দিনে সবাই যখন মুঠোফোন আর ডিজিটাল স্মৃতিতে মেতে আছেন, তখনো প্রিয় ফুটবলারদের চিঠি লেখেন বাহারুল, খবরের কাগজ কেটে বানান ফাইল। প্রতিদিন অনেক দূরে গিয়ে কয়েকটি পত্রিকা সংগ্রহ করে পড়েন। দিনে চার-পাঁচজন সাবেক ফুটবলারের সঙ্গে কথা বলেন, খোঁজখবর নেন। ফুটবলারের বিয়ের ঘটকালিও করে দিয়েছেন।
৬১ বছর বয়সী বাহারুল কুমিল্লা মডার্ন স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন ১২ বছর। ১০-১২ বছর ধরে গ্রামের বাড়িতে থাকেন। তবে কুমিল্লায় বড় কোনো খেলা হলে এখনো ছুটে যান, বড় ম্যাচ দেখতে ছুটে আসেন ঢাকা। সময়ের বাইরে দাঁড়িয়ে ধরে রেখেছেন দেশের ফুটবলের টুকরা টুকরা দলিল। তাঁর এই সংগ্রহই হয়তো একদিন হয়ে উঠবে বাংলাদেশ ফুটবলের বিকল্প আর্কাইভ।