এক দিনের সিদ্ধান্তে পেশা বদলে ফেললেন ফায়জা আহমেদ
ফায়জা আহমেদ তখন একটি অন্দরসজ্জা প্রতিষ্ঠানের মালিক। মাসিক যা উপার্জন, তাতে হেসেখেলে নির্ভার দিন কাটানো যায়। কিন্তু ফায়জার ভেতরটা খচখচ করে। কেন? ‘দেশের ঐতিহ্য মাথায় রেখে নকশা করতে চাইতাম, কিন্তু বেশির ভাগ গ্রাহক বাড়িঘর বা অফিস সাজাতে বিদেশি নকশার কথা বলতেন। তারা হয়তো বলতেন, গুগলের অফিসের মতো করে সাজিয়ে দিন!’ ফায়জার সরল উত্তর।
গ্রাহকের চাহিদামতো কাজটা হয়তো করতেন, কিন্তু মন থেকে মানতে পারতেন না। নিজের সৃজনশীলতা দিয়ে কাজ করতে না পারার আক্ষেপ দিনে দিনে বাড়তে থাকল। একদিন স্থির করলেন, না, এভাবে আর নয়। ফায়জা বলেন, ‘দিনটি ছিল আমার জন্মদিন (২০১৩ সালের ৩১ অক্টোবর)। এক দিনের সিদ্ধান্তে পেশা বদলে ফেললাম।’
পড়াশোনা যেহেতু চারুকলার অঙ্কন ও চিত্রায়ণ বিভাগে করছেন, সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চাইলেন। ঠিক করলেন পোশাকেই শিল্পচর্চা করবেন। সামান্য পুঁজি নিয়ে ১৬টি তাঁতের শাড়ি কিনলেন। বাংলা ভাষার বিখ্যাত কবি, লেখকদের কবিতা গান জুড়ে সাধারণ শাড়িগুলোই করে তুললেন ‘অসাধারণ’। বিক্রিও হয়ে গেল। আস্তে আস্তে প্রশংসা পেতে শুরু করলেন। পান্থপথেই ছোট একটা অফিস নিলেন। নাম দিলেন ‘মানাস’। ফায়জা আহমেদের ‘মানাস’ আজ দেশের ফ্যাশন জগতে পরিচিত এক নাম। এক যুগের এই যাত্রা সহজ ছিল না। আলাপচারিতায় নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে ‘একগুঁয়ে’, ‘জেদি’ শব্দগুলো বেশ কয়েকবার উচ্চারণ করলেন ফায়জা আহমেদ। ডিজাইনার হিসেবে ‘মানাস’কে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে তাঁর এই সব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নাকি বেশ কাজে দিয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটি ফায়জা আহমেদকে শুধু অর্থনৈতিক মুক্তিই দেয়নি, জুগিয়েছে মানসিক শান্তি, অন্দরসজ্জা প্রতিষ্ঠান থেকে যেটা তিনি পাচ্ছিলেন না। মানাসের প্রতিটি পণ্যে দেশীয় উপকরণ ব্যবহার করেন তিনি। তবে শুরু থেকেই ফায়জাকে শুনতে হয়েছে, পণ্যের দাম খুব বেশি! দ্বিমত করলেন না তিনি, ‘মানাসে আমি সাধারণ একটা শাড়ি বা টপ বিক্রি করি না। ভাবনা আর গল্প বিক্রি করি। বাংলাদেশের ঐতিহ্য আর চেতনাকে তুলে ধরার চেষ্টা করি। এ কারণেই পোশাকের দাম বেশি। একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষই আমার পোশাক বেশি কেনেন।’ জানালেন, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, লালন ফকির, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, সত্যজিৎ রায়, জর্জ হ্যারিসন, বব মার্লেসহ ব্রিটিশ রক ব্যান্ড পিংক ফ্লয়েডের সৃষ্টিকর্ম নিয়ে পোশাকে কাজ করেছেন। ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর টিকিটের নকশাও মানাসের পোশাকে উঠে এসেছে।
খাদি উৎসবে তুলে ধরেছিলেন ষাট গম্বুজ মসজিদের নকশা। আয়োজন করেছিলেন ‘আত্মাবালা’ শিরোনামে ফ্যাশন শো। আরেকটি ফ্যাশন শোয়ে তুলে ধরেছেন ফিলিস্তিনের সংকট, যেখানে উঠে আসে নারীদের জীবনের নানা টানাপোড়েন আর যুদ্ধের সংকট। ফ্যাশন শোটি সম্পর্কে ফায়জা বলেন, ‘এটা ছিল একধরনের আন্দোলনের মতো। কোথাও তো লিখতে পারছি না। তাই আমার কাজের মধ্য দিয়েই মনের কথাগুলো তুলে ধরেছিলাম।’
সঞ্চয়িতার নিরামিষ
ফ্যাশন হাউসের পাশাপাশি একই সময়ে নিজের একটি রেস্তোরাঁও দাঁড় করিয়েছেন ফায়জা। রবীন্দ্রনাথের কাব্য সংকলনের নামে রেস্তোরাঁর নাম—সঞ্চয়িতা। ২০১৪ সালে যখন শুরু করেছিলেন, তখন নানা পদের খাবার থাকলেও সঞ্চয়িতার সব খাবারই এখন ভেগান বা নিরামিষ। কেন? উত্তরে ছেলে সুনীয়েল হাসান লিওমিথকে নিয়ে থাইল্যান্ডের একটি অভিজ্ঞতা শোনালেন, ‘২০১৭ সালে ব্যাংককে ফুড কোর্টে খেতে বসেছি। পাশেই ঝোলানো ছিল হাঁস, মুরগি। সেগুলো দেখেই ছোট্ট ছেলেটা জানতে চাইল, প্রাণীদের তো খাওয়াই হবে, তবে এত নিষ্ঠুরভাবে কেন? কাটার পর উল্টো করে ঝুলিয়ে বারবিকিউ করা হচ্ছে, প্রক্রিয়াটা দেখতেও ওর অস্বস্তি হচ্ছিল। ছেলের সংবেদনশীলতা আমাকে নাড়া দিল।’ এর পর থেকেই সঞ্চয়িতার পদে আসে পরিবর্তন।
ফায়জা আহমেদ এখন পোশাকের উপকরণ সংগ্রহ, তাঁতিদের সঙ্গে যোগাযোগ নকশা যেমন করেন, তেমনই সঞ্চয়িতার রসুইঘরেও থাকে তাঁর নজর, হাতের ছোঁয়া। এ ছাড়া ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব বাংলাদেশসহ দেশের বিভিন্ন ফ্যাশন ও নারী উদ্যোক্তাদের সংগঠনে যুক্ত আছেন। এসবেই খুঁজে পেয়েছেন মনের শান্তি।