প্রিন্সেস ডায়ানাকেও পোশাকের ব্যাপারে ‘না’ শুনতে হয়েছিল কেন?

পোশাকের মাধ্যমে নিজের মনের কথা বলতে শুরু করেছিলেন ডায়ানা
ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে

প্রিন্সেস ডায়ানা মারা গেছেন প্রায় ২৮ বছর আগে; কিন্তু ফ্যাশনে এখনো যেকোনো জীবিত রাজকুমারীর চেয়ে জনপ্রিয় তিনি। খুঁজলে মিলেনিয়ালদের মধ্যেও পাওয়া যাবে তাঁর অগণিত ভক্ত। তিনি ছিলেন স্টাইল আইকন। ব্যক্তিগত আচরণ, মানবতাবোধ আর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্য তাঁকে মাথায় তুলে রেখেছিল পুরো বিশ্ব। পাশাপাশি তিনি ছিলেন এমন এক নারী, রাজপরিবারের কঠোর নিয়ম ভাঙার সাহস যিনি দেখিয়েছিলেন।

তবে রাজকুমারী হলেই যে ইচ্ছেমতো চলা যায়, তা কিন্তু নয়। মাঝেমধ্যে ‘না’ শুনতেই হয়। ডায়ানার প্রিয় ডিজাইনারদের একজন জ্যাক আজাগুরি একবার এমন একটি পোশাকের ব্যাপারে তাকে ‘না’ করেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, রাজকুমারীর জন্য এই পোশাক না। সম্প্রতি লস অ্যাঞ্জেলেসে এক নিলামে বিক্রি হয়েছে ডায়ানার পোশাকের কপি। নিলামের আগে দেওয়া বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে ডায়ানার ফ্যাশন ভাবনা নিয়ে বেশ কিছু কথা বলেছেন আজাগুরি। ডায়ানা কী পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন, কেন ডিজাইনার শোনেননি তাঁর কথা আর ডায়ানা কীভাবে সাড়া দিয়েছিলেন—সাক্ষাৎকারগুলোতে এসবই উঠে এসেছে।

ফ্যাশনকে কীভাবে দেখতেন ডায়ানা?

ডায়ানার কাছে ফ্যাশন ছিল নিজের অনুভূতি ও ব্যক্তিত্ব প্রকাশের একটি উপায়। চার্লসের সঙ্গে বিবাহিত অবস্থায় পোশাক নিয়ে রাজপরিবারে অনেক কড়াকড়িই তাঁকে মেনে চলতে হয়েছে। স্কার্টের দৈর্ঘ্য, রং, গলার কাট—সবকিছুতেই নিয়ম মানতে হতো তাঁকে। জ্যাক আজাগুরি, ক্যাথরিন ওয়াকার, আনিয়া হিন্দমার্চ, মুরে অ্যারবেইড—যাঁদের পোশাক পরে তিনি ফ্যাশন আইকনে পরিণত হয়েছিলেন, তাঁদের পোশাকগুলোও  রাজপরিবারের নিয়ম মেনেই ডায়ানার বেছে নিতে হতো; কিন্তু যখন ডায়ানার বিয়ে ভেঙে গেল, তখন তিনি স্বাধীনতা পেলেন। পোশাকের মাধ্যমে নিজের মনের কথা বলতে শুরু করলেন।

এই পোশাকটি হয়ে ওঠে ডায়ানার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় সাজ
ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে

১৯৯৪ সালের যেই রাতে টিভিতে এক সাক্ষাৎকারে চার্লস বলেছিলেন, আরেকজনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আছে, সেই রাতেই ডায়ানার পরা ছোট কালো পোশাক মনে আছে? ভ্যানিটি ফেয়ারের গালায় তাঁর পরা সেই সাহসী কালো পোশাক একটি শব্দ উচ্চারণ না করেও যেন অনেক কিছু বলে দিয়েছিল। পোশাকটি হয়ে ওঠে তাঁর জীবনের অন্যতম স্মরণীয় সাজ। এর পরও তাঁর পোশাকে এ রকম অনেক লুক দেখা গেছে।
‘এটা ছিল তাঁর নতুন জীবনের শুরু’, ফক্স নিউজ ডিজিটালকে বলেন আজাগুরি। ‘তখন তিনি ফিট ছিলেন, নিয়মিত ব্যায়াম করতেন। দেখতে ছিলেন অসাধারণ। আর তাঁর পোশাকগুলো ঠিক সেটিই বলছিল, যা তিনি বলতে চাইছিলেন, তিনি এখন স্বাধীন নারী। নিজের ইচ্ছেমতো যা খুশি পরতে পারেন। এটা একধরনের বিদ্রোহও ছিল। সবাইকে জানানোর একটি উপায়ও ছিল যে এখন ‘তিনিই তাঁর নিজের মালিক।’

আরও পড়ুন

ডায়ানাকে কোন পোশাক পরতে মানা করা হয়েছিল?

খুবই ছোট একটি ড্রেস! ১৯৯৭ সালের ৩ জুন লন্ডনের রয়্যাল আলবার্ট হলে ‘সোয়ান লেক’ ব্যালে দেখার সময় ডায়ানা আকাশি রঙের একটি ড্রেস পরেছিলেন। এটি রাজকুমারীর জন্য বেশ সাহসী ছিল। পোশাকটি ছিল শরীরের সঙ্গে লাগানো, গলার অংশটি ছিল খোলামেলা; কিন্তু আজাগুরির কথায়—ডায়ানা চেয়েছিলেন এটি আরও ছোট হোক।

এই পোশাকটিকেই আরও খাটো করতে চেয়েছিলেন ডায়ানা
ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে

আজাগুরি একটি পডকাস্টে বলেন, ‘তিনি যখন স্কার্ট আরও ছোট করতে চাইলেন, আমি না করেছিলাম। তাঁর বাটলার পল বারেল ও আমি তাঁকে বলেছিলাম, “ছোটর মধ্যে এটিই সবচেয়ে লম্বা।” তিনি  চেয়েছিলেন আরও ছোট; কিন্তু আমরা বলেছিলাম, “ওপরেও তো কম কাপড়, নিচেও কম, মাঝখানে তো আর কিছু থাকবে না।’”
আজাগুরি জানান, ডায়ানাকে বলা হয়েছিল, যদিও তিনি আর বিবাহিত নন, তবুও একজন রাজকুমারী হিসেবে জনসমক্ষে কেমন দেখা যায়, সে বিষয়ে তাঁকে সাবধান হতে হবে। শেষে ডায়ানা রাজি হয়েছিলেন, তাই পোশাকের দৈর্ঘ্য যা ছিল, তাতে আর কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। সুপার মিনি না হোক, সেদিনের শিরোনাম দখল করেছিল এই ড্রেস। যদিও সাধারণ মানুষ সেই সময় পেছনের গল্পটা জানতেন না। জ্যাক আজাগুরির ডিজাইন করা পোশাকটিতে ছিল ক্রিস্টালের বিড আর হেপবার্ন স্টাইলের ফিতা। রংটিও ডায়ানার চোখের সঙ্গে মিলে গিয়েছিল। সোয়ান লেকের পোশাকটি আজও সুন্দর ও স্মরণীয় পোশাকের মধ্যে একটি।

আরও পড়ুন

‘বিদ্রোহী’ পর্যায়ে আর কী কী পোশাক পরেছিলেন?

ভেনিস ড্রেস
১৯৯৫ সালের ৮ জুন ভেনিসের পেগি গুগেনহেইম মিউজিয়ামে বিয়েনালে প্রদর্শনীর এক সংবর্ধনায় হাজির হন ডায়ানা। তাঁর গায়ে ছিল আজাগুরির নকশা করা লাল সিল্ক জর্জেটের ঝলমলে টু–পিস। তুলনামূলক খাটো হেমলাইনটি ছিল রাজপরিবারের সদস্যের জন্য বেশ সাহসী।


ওয়াশিংটন ড্রেস
১৯৯৫ সালের ১৮ জুন ওয়াশিংটন ডিসিতে রেডক্রস বল গালা ডিনারে অংশ নেন ডায়ানা। পরেছিলেন উজ্জ্বল লাল রঙের আরেকটি আজাগুরি ড্রেস, যেটিতে ছিল লাল বিডের কাজ। তবে ডায়ানা মানেই একটু খোলা গলার ছোঁয়া। পিঠের গভীর ভি কাটটি সেই সন্ধ্যাতেও সবার চোখ কেড়েছিল।

১৯৯৫ সালের ১৮ জুন ওয়াশিংটন ডিসিতে রেডক্রস বল গালা ডিনারে পরেছিলেন উজ্জ্বল লাল রঙের এই পোশাকটি
ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে

বশির ড্রেস
১৯৯৫ সালের সেপ্টেম্বরে লন্ডনে কালো সিল্কের লম্বা ফিশটেইল হেম ড্রেসটি পরেছিলেন ডায়ানা। একই বছরের ডিসেম্বরে নিউইয়র্কে ক্যানসার রিসার্চ বলেও পরেছিলেন তিনি এ পোশাকটি।


বার্থডে ড্রেস
কালো শ্যান্টিলি লেসের পোশাকটিতে ছিল সাটিন স্ট্র্যাপ, ছোট ছোট সিকুইন আর বিড। কোনো গল্প ছাড়াও এই লুকটি আইকনিক হতো; কিন্তু এর খ্যাতির আসল কারণ—জনসমক্ষে এটিই ছিল রাজকুমারী ডায়ানার পরা শেষ পোশাক। ১৯৯৭ সালের ১ জুলাই, তাঁর ৩৬তম জন্মদিনে লন্ডনের টেট গ্যালারির ডিনারে এটি পরেছিলেন। (এরপর দেড় মাসের কম সময়ের মধ্যে তিনি মারা যান।) আজাগুরি বলেছিলেন, তাঁর জন্য বানানো সব পোশাকের মধ্যে এটিই ছিল প্রিয়।

আরও পড়ুন

ডায়ানার পর থেকে কি অন্য কেউ রাজপরিবারে এতটা সাহসী পোশাক পরেছেন?

হ্যাঁ এবং না। ডায়ানার শেষ কয়েক বছরের মতো এতটা সাহসী বর্তমান রাজপরিবারের নারীরা সাধারণত নন। পাশাপাশি রাজপরিবারের পোশাকের নিয়মগুলোও তাঁরা বেশ ভালোমতো মেনে চলেন। সময় বদলেছে, তাই কিছু ক্ষেত্রে তাঁরা একটু বেশি স্বাধীন হতে পারেন। কেট মিডলটন ও মেগান মার্কেল দুজনই এমন পোশাক পরেছেন, যা আগে রাজপরিবারের অনুমোদন পেত না, যেমন কাঁধখোলা ড্রেস। ২০১৮ সালে মেগান তখনো রাজপরিবারের সদস্য, রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে হালকা গোলাপি রঙের কাঁধখোলা পোশাক পরেছিলেন। ক্যারোলিনা হেরেরার এই পোশাক দেখে অনেকেই ভুরু কুঁচকেছিলেন। ২০১৮ সালে নিউজিল্যান্ডের সরকারি সফরে মেগান যে নীল স্কার্ট পরেছিলেন, সেটি আরও বেশি সাহসী ছিল। পোশাকটি ছিল বেশ স্বচ্ছ।

কালো শ্যান্টিলি লেসের পোশাকটিতে ছিল সাটিন স্ট্র্যাপ, ছোট ছোট সিকুইন আর বিড
ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে

কেট সাধারণত ঝুঁকিপূর্ণ স্টাইল এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন। তারপরও ২০১৪ সালে প্রথম রাজকীয় ভ্রমণে অস্ট্রেলিয়ায় পরা ফুলেল প্রিন্টের জেনি প্যাকহ্যাম সামার ড্রেসটি নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েন। ব্রিসবেন বিমানবন্দরে প্রবল বাতাসে পোশাকটি ওপরের দিকে উঠে যায়, তাতে অন্তর্বাস দেখা যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছিল। পোশাকের নিচে বাড়তি ওজন না দেওয়ার কারণে ওই ডিজাইনারকেও পরে সমালোচিত হতে হয়েছিল। ‘বাতাসের’ এ ঘটনার বাইরে কেটের আরেকটি ছোটখাটো ভুল ছিল। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ জীবিত থাকার সময় বেশ কয়েকবার তিনি কর্ক হিলের ওয়েজেস জুতা পরেছিলেন। রিপোর্ট অনুযায়ী, রানি এটি পছন্দ করতেন না।


সূত্র: রিডার্স ডাইজেস্ট

আরও পড়ুন