তাঁরা ডাক্তার, তবে একটু আলাদা
সাদা অ্যাপ্রন আর স্টেথোস্কোপ। চিকিৎসক জীবনের অবিচ্ছেদ্য দুই অনুষঙ্গ। মেডিসিন, শল্যচিকিৎসা, স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা...চিকিৎসাবিদ্যার এসব শাখায় যাঁদের আমরা কাজ করতে দেখি, স্টেথোস্কোপ আর শল্যচিকিৎসা কক্ষের নানাবিধ যন্ত্রপাতি তাঁদের নিত্যসঙ্গী। তবে এর বাইরেও কিন্তু এমন অনেক চিকিৎসক আছেন, যাঁদের কাজের ক্ষেত্রটা একেবারেই আলাদা।
চিকিৎসাবিদ্যায় ডিগ্রি অর্জনের পর যাঁরা পররাষ্ট্র বা প্রশাসন ক্যাডারের মতো ভিন্ন পেশায় চলে যান, তাঁদের কথা বলছি না। বলছি আরেক দল চিকিৎসকের কথা, যাঁরা ক্লিনিক্যাল বিষয়ে ক্যারিয়ার না গড়ে বেছে নেন ভিন্ন কোনো শাখা। রোগী হিসেবে হাসপাতালে গিয়ে সচরাচর এসব চিকিৎসকের দেখা আমরা পাই না। তাঁরা কেউ গবেষণার কাজে নিযুক্ত, কেউ আবার কাজ করেন ল্যাবরেটরিতে, যেখান থেকে রিপোর্ট পাওয়ার পর নিশ্চিতভাবে নির্ণয় করা যায় রোগ।
এই যেমন কারও সংক্রামক রোগ হলে সেই রোগের জন্য দায়ী জীবাণুটিকে খুঁজে বের করেন অণুজীববিদ্যার চিকিৎসকেরা, আবার ক্যানসার কোষ এবং অন্যান্য অস্বাভাবিক কোষের তফাত বলে দিতে পারেন প্যাথলজির চিকিৎসকেরা। আইনের যে বিষয়গুলো সমাধা করতে চিকিৎসাবিদ্যার সহায়তা প্রয়োজন, সেদিকটায় কাজ করেন ফরেনসিক মেডিসিনের চিকিৎসকেরা। রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর), আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রসহ (আইসিডিডিআরবি) বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিযুক্ত হন নন-ক্লিনিক্যাল চিকিৎসকেরা।
বহুদূর যাওয়ার সুযোগ
ঢাকা মেডিকেল কলেজের অণুজীববিদ্যা বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক এস এম সামসুজ্জামান শোনাচ্ছিলেন ভিন্নধারার পেশায় কাজ করার অন্য রকম অভিজ্ঞতার কথা। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস করার পর সরকারি চাকরিতে ঢুকেছিলেন তিনি। তখনো কিন্তু ভাবেননি অণুজীববিদ্যায় ক্যারিয়ার গড়বেন। ক্লিনিক্যাল বিষয়েই চলছিল তাঁর স্নাতকোত্তর পর্যায়ের প্রশিক্ষণ। ক্লিনিক্যাল বিষয়ে পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন। সেই সময় পরীক্ষাটি অনিবার্য কারণে পিছিয়ে যাওয়ায় হুট করেই অণুজীববিদ্যার পরীক্ষা দেন। সেই পরীক্ষাতেই ইনস্টিটিউট অব পোস্টগ্র্যাজুয়েট মেডিকেল রিসার্চে (আইপিজিএমআর, বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) পড়ার সুযোগ পেয়ে যান। সেখান থেকে এমফিল করার পর জাপানের কোচি মেডিকেল স্কুল থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নেন। জাপানের দিনগুলোয় তিনি দেখেছেন, নন-ক্লিনিক্যাল বিষয়ের গবেষণা দিয়ে এমন অনেক কিছু করা সম্ভব, যা সুস্থ-অসুস্থ সব মানুষের কাজে লাগে। প্রাণঘাতী জীবাণুর বিরুদ্ধে টিকা থেকে শুরু করে কার্যকর ওষুধ আবিষ্কার—সব কাজেই নন-ক্লিনিক্যাল বিষয়ে গবেষণার গুরুত্ব সেই সময় উপলব্ধি করেন তিনি। দেশে ফিরে আসার পরও বহু গবেষণা করেছেন। তাঁর অধীনে এমফিলের গবেষণা করেছেন প্রায় শ’খানেক শিক্ষার্থী। পিএইচডিও হয়েছে তাঁর অধীন। জনস্বাস্থ্যে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার জন্য সম্মানসূচক হু’জ হু অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন ২০০৪ সালে। এখন কাজ করছেন আন্তর্জাতিক ডেটা সেফটি মনিটরিং বোর্ডের সদস্য হিসেবে।
আরেক ভিন্ন পেশার চিকিৎসক অধ্যাপক মালবিকা সরকারের কথা কিছুদিন আগেই প্রকাশিত হয়েছে এই ‘স্বপ্ন নিয়ে’ পাতায়। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করে একসময় জনস্বাস্থ্য পেশায় যোগ দেন তিনি। তাঁর কাজের ক্ষেত্র মূলত ‘ইমপ্লিমেন্টেশন রিসার্চ’। অর্থাৎ কোনো রোগনিয়ন্ত্রণের কর্মসূচি ঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না, তা নিয়েই গবেষণা করেন তিনি। জনস্বাস্থ্যে অবদানের জন্য ২০১৮ সালে ‘হিরোইন অব হেলথ’ স্বীকৃতি পেয়েছিলেন মালবিকা সরকার। এখন যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন ইউনিভার্সিটির বিহেভিয়রাল অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কাজ করছেন। যুক্ত আছেন নানা গবেষণায়ও।
জীবনের লক্ষ্যপূরণ
ডা. রজত দাশগুপ্ত সুদূর যুক্তরাষ্ট্র থেকে শোনালেন জীবনের লক্ষ্যপূরণের গল্প। ছোটবেলা থেকে শুনেছেন, ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করলেই জীবন সার্থক। কিন্তু ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ার সুযোগ পেয়েও তাঁর মনে হয়নি, লক্ষ্যপূরণ হলো। পড়তে পড়তে একসময় উপলব্ধি করেন, সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যসচেতনতা সৃষ্টি কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এই উপলব্ধি থেকেই জীবনের সত্যিকার লক্ষ্যের দেখা পান তিনি। এমবিবিএস শেষে ব্র্যাক জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ থেকে এমপিএইচ (জনস্বাস্থ্যে স্নাতকোত্তর) সম্পন্ন করেন। ২০১৯ সালে ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ক্যারোলাইনায় রোগতত্ত্বের ওপর পিএইচডি গবেষণার সুযোগ পান। কাজের ফাঁকেই জানালেন, ‘চিকিৎসক হলেই রোগী দেখতে হবে, এমন কোনো বিধিবিধান তো নেই। যার যেখানে হৃদয়, তার সেখানেই কাজ করা উচিত।’ আরও জানালেন, ইউনিসেফ, সেভ দ্য চিলড্রেন, যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ, সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নন-ক্লিনিক্যাল বিষয়ের চিকিৎসকদের কাজের সুযোগ আছে।
আছে শিক্ষকতার সুযোগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মাকোলজিতে এমডি করছেন ডা. সুমাইয়্যা নওশীন। শিক্ষকতা তাঁর ভালো লাগার পেশা। তাঁর মতে, একজন শিক্ষকই পারেন শিক্ষার্থীদের কাছে পড়ালেখাটাকে আনন্দময় করে তুলতে। স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পর সে পথেই হাঁটতে চান তিনি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজে ফিজিওলজিতে এমফিল করছেন ডা. ফারাহ তাসনিম। শিক্ষকতা তাঁরও পছন্দের পেশা। ভবিষ্যতে গবেষণাধর্মী কাজ করার ইচ্ছাও আছে। এমবিবিএস পর্যায়ে যেকোনো শিক্ষার্থীকে অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, অণুজীববিদ্যা, প্যাথলজি, কমিউনিটি মেডিসিন এবং ফরেনসিক মেডিসিন, অর্থাৎ নন-ক্লিনিক্যাল বিষয়গুলো পড়তেই হয়। এসব বিষয়কে ক্যারিয়ার হিসেবে নিলে তাই সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোয় শিক্ষকতার সুযোগ পাওয়া যায়।