২০ দিনে এক হাজার কিলোমিটার দৌড়ানোর পর আত্মবিশ্বাস পেলাম
ফ্রান্সের নিসে হয়ে গেল আয়রনম্যান বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ। গত মাসে অনুষ্ঠিত এই আসরে টানা তিনবার অংশ নিয়ে প্রতিবারই সফল হয়েছেন বাংলাদেশের আয়রনম্যান মোহাম্মদ শামছুজ্জামান আরাফাত। নিজের আয়রন ম্যান অভিযাত্রার গল্প শোনালেন তিনি।
সাঁতার শেষ করে মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই সাইকেলে উঠে পড়লাম। ভূমধ্যসাগরে ৩ দশমিক ৮ কিলোমিটার সাঁতার কেটেছি। এবার ১৮০ কিলোমিটার সাইকেল চালাতে হবে। ফ্রান্সের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে এ পর্বটাই আমার জন্য বেশি চ্যালেঞ্জিং। কারণ, পাহাড়ি রাস্তা। আমি সমতল থেকে আসা মানুষ। ঢাকার ৩০০ ফিট রাস্তায় সাইকেলে অনুশীলন করেছি।
১০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতেই প্রথম চড়াই। পাহাড়ে গা বেয়ে ওপরে উঠতে গিয়ে টের পেলাম সামনের পথটুকু কতটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে অপেক্ষা করছে। চড়াই উঠে ভেবেছিলাম উতরাই সহজ হবে, সাঁই সাঁই নেমে যাব। কিন্তু পথ এতটাই আঁকাবাঁকা যে ওঠার চেয়েও কঠিন হয়ে গেল নামা। ব্রেক চেপে চেপে নামতে হলো। আর এভাবেই চড়াই-উতরাই পার করে করে আরও উঁচুতে উঠতে থাকলাম।
পাথুরে পাহাড়ি পথে চলতে চলতে কত কথাই না মনে পড়ল, ২০১৩ সালে প্রথম যখন খেলাটা সম্পর্কে জানি, বিশ্বাসই করতে পারিনি ১৭ ঘণ্টার মধ্যে ৩ দশমিক ৮ কিলোমিটার সাঁতার, ১৮০ কিলোমিটার সাইক্লিং আর ৪২ দশমিক ২ কিলোমিটার দৌড় শেষ করা সম্ভব! তারপরও একবার আয়রনম্যান সম্পন্ন করার স্বপ্ন চেপে বসল। দেশ থেকে এই আসরে আগে কেউ আসেনি। তথ্য ও পরামর্শের জন্য ইন্টারনেটই ভরসা। খোঁজ করে ট্রায়াল-এরর বেসিসে অনুশীলন শুরু করলাম। ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালে টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিন তিন বছরে তিনবার সাঁতার আর ২০১৭ সালে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া ২০ দিনে এক হাজার কিলোমিটার দৌড়ানোর পর আত্মবিশ্বাস পেলাম। সে বছরই মালয়েশিয়ায় প্রথম আয়রনম্যানে অংশ নিই। আসরে যা দেখেছি, তাতেই অবাক হয়েছি। সেবার ১২ ঘণ্টা ৪৩ মিনিট সময় নিয়ে সম্পন্ন করলাম। জানলাম, এর মাধ্যমে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে নির্বাচিত হয়েছি। সেই থেকে শুরু বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের স্বপ্ন। ২০২২ সালে এসে সে স্বপ্ন পূরণ হলো। যুক্তরাষ্ট্রের ইউটাতে আয়রনম্যান বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথম অংশ নিয়ে দেশের পতাকাকে পতপত করে উড়তে দেখে মন ভরে গেল। এবার তৃতীয়বার অংশ নিয়ে পুরোনো দিনগুলোর কথাই বেশি বেশি মনে পড়ল। সাইকেলের পেছনের গিয়ার শিফটার টা মিস প্লেস হতেই স্মৃতির চটকা ভেঙে গেল।
চড়াই উঠতে এখন পায়ে অনেক চাপ পড়ছে। উতরাই আরও কঠিন হয়ে গেছে। নামতে নামতে পথে দেখতে পেলাম অনেক অ্যাথলেট মারাত্মক আহত হয়েছেন। তাঁদের দেখে ভয় পেয়ে গেলাম। একটা সময় মনে হলো, এবার পার হতে পারলে এ রকম ভয়ংকর ক্লাইম্বিংয়ে আর আসব না! সেই অনিশ্চয়তা নিয়েই পাহাড়ি পথ শেষ হয়ে গেল। শুরু হলো সমতল। ১৭০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়েছি। বাকি ১০ কিলোমিটার রাস্তায় প্যাডল মারতে মারতে আত্মবিশ্বাসের পারদ চড়ল, মনে হতে থাকল এই বুঝি রেস সম্পন্ন করে ফেলেছি। অথচ তখনো বাকি আছে আরেক পর্ব, ৪২ দশমিক ২ কিলোমিটার দৌড়!